- বইয়ের নামঃ ভ্রান্তিবিলাস
- লেখকের নামঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
১. হেমকূট ও জয়স্থল
বিজ্ঞাপন
কিছু দিন পূর্ব্বে, ইংলণ্ডের অদ্বিতীয কবি সেক্সপীরের প্রণীত ভ্রান্তিপ্রহসন পাঠ করিয়া আমার বোধ হইয়াছিল, এতদীয় উপাখ্যানভাগ বাঙ্গালাভাষায় সঙ্কলিত হইলে, লোকের চিত্তরঞ্জন হইতে পারে। তদনুসারে ঐ প্রহসনের উপাখ্যানভাগ বাঙ্গালাভাষায় সঙ্কলিত ও ভ্রান্তিবিলাস নামে প্রচারিত হইল।
সেক্সপীর, পঁয়ত্রিশখানি নাটক রচনা করিয়া, বিশ্ববিখ্যাত ও চিরস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রণীত নাটকসমূহে কবিত্বশক্তির ও রচনাকৌশলের পরা কাষ্ঠা প্রদর্শিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতিরিক্ত, তিনি চারিখানি খণ্ড কাব্য ও কতকগুলি ক্ষুদ্রকাব্য রচনা করিয়াছেন। অনেকে বলেন, তিনি যে কেবল ইংলণ্ডের অদ্বিতীয় কবি ছিলেন, এরূপ নহে; এ পর্য্যন্ত ভূমণ্ডলে যত কবি প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন, কেহই তাঁহার সমকক্ষ নহেন। এই সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত বা পক্ষপাতবিবর্জিত কি না, মাদৃশ ব্যক্তির তদ্বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া নিরবচ্ছিন্ন প্রগল্ভতাপ্রদর্শন মাত্র।
ভ্রান্তিপ্রহসন কাব্যাংশে সেক্সপীরের প্রণীত অনেক নাটক অপেক্ষা অনেক অংশে নিকৃষ্ট; কিন্তু উহার উপাখ্যানটি যার পর নাই কৌতুকাবহ। তিনি এই প্রহসনে হাস্যরস উদ্দীপনের নিরতিশয় কৌশল প্রদর্শন করিয়াছেন। পাঠকালে হাস্য করিতে করিতে শ্বাসরোধ উপস্থিত হয়। ভ্রান্তিবিলাসে সেক্সপীরের সেই অপ্রতিম কৌশল নাই, সুতরাং, ইহা পাঠ করিয়া লোকের তাদৃশ চিত্তরঞ্জন হইবেক, তাহার সম্ভাবনা নাই।
বাঙ্গালাপুস্তকে ইয়ুরোপীয় নাম সুশ্রাব্য হয় না; বিশেষতঃ, যাঁহারা ইঙ্গরেজী জানেন না, তাদৃশ পাঠকগণের পক্ষে বিলক্ষণ বিরক্তিকর হইয়া উঠে। এই দোষের পরিহারবাসনায়, ভ্রান্তিবিলাসে সেই সেই নামের স্থলে এতদ্দেশীয় নাম নিবেশিত হইয়াছে। উপাখ্যানে এবংবিধ প্রণালী অবলম্বন করা কোনও অংশে হানিকর বা দোষাবহ হইতে পারে না। ইতিহাসে বা জীবনচরিতে নামের যেরূপ উপযোগিতা আছে, উপাখ্যানে সেরূপ নহে।
যদি ভ্রান্তিবিলাস পাঠ করিয়া, এক ব্যক্তিরও চিত্তে কিঞ্চিন্মাত্র প্রীতিসঞ্চার হয়, তাহা হইলেই শ্রম সফল বোধ করিব।
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা
বর্দ্ধমান।
৩০ এ আশ্বিন। সংবৎ ১৯২৬।
————–
প্রথম পরিচ্ছেদ
হেমকূট ও জয়স্থল নামে দুই প্রসিদ্ধ প্রাচীন রাজ্য ছিল। দুই রাজ্যের পরস্পর ঘোরতর বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে, জয়স্থলে এই নৃশংস নিয়ম বিধিবদ্ধ হয়, হেমকূটের কোনও প্রজা, বাণিজ্য বা অন্যবিধ কার্য্যের অনুরোধে, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিলে তাহার গুরুতর অর্থদণ্ড, অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হইলে প্রাণদণ্ড, হইবেক। হেমকূটরাজ্যেও, জয়স্থলবাসী লোকদিগের পক্ষে, অবিকল তদ্রূপ নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় রাজ্যই বাণিজ্যের প্রধান স্থান। উভয় রাজ্যের প্রজারাই উভয়ত্র বিস্তারিত রূপে বাণিজ্য করিত। এক্ষণে, উভয় রাজ্যেই উল্লিখিত নৃশংস নিয়ম ব্যবস্থাপিত হওয়াতে, সেই বহুবিস্তৃত বাণিজ্য এক কালে রহিত হইয়া গেল।
এই নিয়ম প্রচারিত হইবার কিঞ্চিৎ কাল পরে, সোমদত্ত নামে এক বৃদ্ধ বণিক, ঘটনাক্রমে জয়স্থলে উপস্থিত হইয়া, হেমকূটবাসী বলিয়া পরিজ্ঞাত ও বিচারালয়ে নীত হইলেন। জয়স্থলে অধিরাজ বিজয়বল্লভ স্বয়ং রাজকার্য্য পর্য্যবেক্ষণ করিতেন। তিনি, সবিশেষ অবগত হইয়া, সোমদত্তের দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ পূর্ব্বক কহিলেন, অহে হেমকূটবাসী বণিক! তুমি, প্রতিষ্ঠিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছ, এই অপরাধে আমি তোমার পাঁচ সহস্র মুদ্রা দণ্ড করিলাম; যদি অবিলম্বে এই দণ্ড দিতে না পার, সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড হইবেক।
অধিরাজের আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া, সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে আমার প্রাণদণ্ড করুন, তজ্জন্য আমি কিছুমাত্র কাতর নহি। আমি অহর্নিশ দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করিতেছি; মৃত্যু হইলে পরিত্রাণ বোধ করিব। কিন্তু, মহারাজ! যথার্থ বিচার করিলে, আমার দণ্ড হইতে পারে না। সাত বৎসর অতীত হইল, আমি জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়া দেশপর্য্যটন করিতেছি। যৎকালে হেমকূট হইতে প্রস্থান করি, উভয় রাজ্যের পরস্পর বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল। এক্ষণে পরস্পর যে বিরোধ ঘটিয়াছে, এবং ঐ উপলক্ষে উভয় রাজ্যে যে এরূপ কঠিন নিয়ম বিধিবদ্ধ হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। যদি, প্রচারিত নিয়মের বিশেষজ্ঞ হইয়া, আপনকার অধিকারে প্রবেশ করিতাম, তাহা হইলে আমি অবশ্য অপরাধী হইতাম।
এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া, বিজয়বল্লভ কহিলেন, শুন, সোমদত্ত! জয়স্থলের প্রচলিত বিধি সর্ব্বতোভাবে প্রতিপালন করিয়া চলিব, কদাচ তাহার অন্যথাচরণ করিব না, ধর্ম্মপ্রমাণ এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, আমি অধিরাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছি। সুতরাং জয়স্থলে, হেমকূটবাসী লোকদিগের পক্ষে যে সমস্ত বিধি প্রচলিত আছে, আমি প্রাণান্তেও তাঁহার বিপরীত আচরণ করিতে পারিব না। জয়স্থলের কতিপয় পোতবণিক দুই রাজ্যের বিরোধ ও অভিনব বিধি প্রচলনের বিষয় কিছুমাত্র অবগত ছিল না। তাহারাও, তোমার মত, না জানিয়া হেমকূটের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিল। তোমাদের অধিরাজ, নবপ্রবর্ত্তিত বিধির অনুবর্ত্তী হইয়া, প্রথমতঃ, তাহাদের অর্থদণ্ড বিধান করেন। অর্থদণ্ড প্রদানে অসমর্থ হওয়াতে, অবশেষে তাহাদের প্রাণদণ্ড হইয়াছে। এই নৃশংস ঘটনা জয়স্থলবাসীদিগের অন্তঃকরণে সম্পূর্ণ জাগরূক রহিয়াছে। এ অবস্থায়, আমি, প্রচলিত বিধি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করিতে পাবি না। অবিলম্বে পাঁচ সহস্র মুদ্র দিতে পারিলে, তুমি অক্ষত শরীরে স্বদেশে প্রতিগমন করিতে পার; কিন্তু আমি তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না; কারণ, তোমার সমভিব্যাহারে যাহা কিছু আছে, সমুদয়ের মূল্য ঊর্দ্ধসংখ্যায় দুই শত মুদ্রার অধিক হইবেক না; সুতরাং সায়ংকালে তোমার প্রাণদণ্ড একপ্রকার অবধারিত বলিতে হইবেক।