এজন্যেই কোনো দেশের, সমাজের বা জাতির সংস্কৃতিকে ধর্মের বাঁধনে, সমাজের শাসনে, নীতির নিগড়ে, কালের পরিসরে, দেশের সীমায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে অথবা গোত্র বা জাতি-চেতনার অনুগত করে রাখা চলে না।
যে-কোনো মানুষের সংস্কৃতিতে কিছু ধর্মীয় আচারের রঙ, কিছু দেশের জলবায়ুর প্রভাব, কিছু ভাষার রস, কিছু প্রয়োজনের রেশ, কিছু শিক্ষার ফল, কিছু সম্পদের ছাপ, কিছু জ্ঞানের লাবণ্য, কিছু বিদ্যার দান, কিছু হৃদয়বৃত্তির প্রসূন, কিছু মননের মসৃণতা, কিছু প্রজ্ঞার দীপ্তি, কিছু মানবিকতার মাধুর্য, কিছু কল্যাণ-চিন্তার স্নিগ্ধতা থাকেই। সবকিছুর সমন্বয়ে সংস্কৃতি মানুষকে সৃজন করে। তাই সৌজন্যেই সংস্কৃতির পরিচয়। সুজন মাত্রেই মনুষ্যত্বসম্পন্ন। কাজেই সৌজন্যের অপর নাম পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব। অতএব সংস্কৃতি মানবতারই নামান্তর। একজন মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষই কেবল সুজন ও সুনাগরিক হতে পারে। এমন মানুষ অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণের শত্রু। একজন জীবনসচেতন সত্যসন্ধ সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ তার মানবিক দায়িত্বে ও কর্তব্যে অবহেলা করে না।
এমন সৌজন্য, দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যবুদ্ধি যে-দেশের অধিকাংশ মানুষে সুলভ, সে-দেশের মানুষ সামগ্রিক পরিচয়ে তাই সংস্কৃতিবান বলে অভিহিত হয়। এ অর্থে সংস্কৃতি জীবনবোধের ও জীবনাদর্শের বা জীবননীতির পরিমাপকও। বলেছি, বিশ্ব-মানবের মধ্যে বৈচিত্র্যে ঐক্য এবং ঐক্যে বৈচিত্র্যই সংস্কৃতির সাধারণ লক্ষণ।
আমরা বাঙালিরা অন্তত দু-হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতিবান জাতি। মানবিক ঐতিহ্য আমরা একদিকে যেমন দেশ-কাল নিরপেক্ষ সংস্কৃতির ধারক, অন্যদিকে তেমনি আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট। এক কথায় আমরা সামান্য ও স্বকীয় সংস্কৃতির ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের সাক্ষ্যে প্রমাণিত যে, আমরা পরধর্ম গ্রহণ করেও তাকে নিজের প্রয়োজনে রূপান্তরিত করে স্বকীয় ও স্বতন্ত্র করে নিয়েছি বারবার। আমরা ধার করেছি কিন্তু অনুকরণ করিনি। বীজ নিয়েছি অন্যের থেকে, কিন্তু স্বকীয় চেতনার, মননের ও আদর্শের পরিচর্যায় আমরা আমাদের মনের মতো ফল ফলিয়েছি। ধর্মে, দর্শনে, ন্যায়ে, আচারে ও চিন্তায় আমরা সত্যকে আবিষ্কার করতে চেয়েছি। সুন্দরের অনুধ্যান ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়েছি, মানবতাকেই মানবধর্ম বলে: স্বীকার করেছি। লোকহিতের অঙ্গীকারে জীবনপ্রয়াস নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছি। স্বদেশকে, স্বভাষাকে, স্বজাতিকে ও স্বরাষ্ট্রকে ভালোবাসতে শিখেছি। যুদ্ধকে, বিসম্বাদকে, উৎপীড়নকে, স্বার্থপরতাকে ঘৃণা করতে জেনেছি। বিশ্বের পীড়িত-শোষিত মানুষের কান্নায় বিচলিত হয়ে সাড়া দিতে এগিয়ে এসেছি। মনুষ্যত্ব অর্জনে নিষ্ঠা, জীবনে-সমাজে-রাষ্ট্রে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা প্রয়াস, মানববাদের জয় কামনা, শান্তির সাধনা, আমাদের সংস্কৃতিকে উজ্জ্বল ও কালানুগ করেছে। আবার আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্র, অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জীবনযাত্রার আঞ্চলিক প্রভাব, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার অসমতা, ঐতিহ্য ও ইতিহাস আমাদের সংস্কৃতিকে অনন্য স্বাতন্ত্র দিয়েছে।
অতএব সংস্কৃতিতে রয়েছে দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্ব। সংস্কৃতি একাধারে যেমন দেশ-কাল- জাত ধর্ম নিরপেক্ষ (কেননা, সৌন্দর্যে, কল্যাণে ও মানবতায় দেশ-কাল-জাত-ধর্মের পার্থক্য স্বীকৃত নয়, তেমনি দৈশিক-কালিক-জাতিক, ধার্মিক ও বৈষয়িক আভরণও থাকে অবিচ্ছেদ্যরূপে সংস্কৃতিতে লগ্ন। কেননা মানুষের প্রয়াস দেশগত ও প্রয়োজনগত চেতনার অনুগত। কাজেই মানুষের সংস্কৃতি একই লক্ষ্যে অনুশীলিত বলেই তা যেমন সর্বমানবিক; আবার দেশ, কাল ও প্রয়োজনের প্রভাব স্বীকার করে বলে তা তেমনি ব্যক্তিক, সামাজিক, আঞ্চলিক আর ধার্মিকও বটে। সংস্কৃতিতে আমরা তাই বহুতে একের সংহতি, একেতে বহুর বিকাশ লক্ষ্য করি।
পুনরুক্তি দোষ ঘটছে জেনেও বলছি–সৌজন্যেই সংস্কৃতির পরিচয়। মনুষ্যত্বই সংস্কৃতির উৎস ও প্রসূন, বীজ ও ফল। কেননা মনুষ্যত্বই মানুষের সৌন্দর্য-অন্বেষা, কল্যাণ-বুদ্ধি ও মানবপ্রীতি জাগায়। আর কে অস্বীকার করবে যে সৌন্দর্যপ্রিয়তা, কল্যাণকামিতা ও মানবপ্রীতিই সংস্কৃতিবানতার শেষ লক্ষ্য?