তেমনি এককালের গোত্রীয় ঐক্য সংকীর্ণতা ও বর্বরতা বলে গর্হিত হয়ে ধর্মীয় ঐক্যে মহিমা আরোপিত হয়েছে, আবার তা বর্জিত হয়ে সাম্প্রদায়িক ঐক্য হয়েছে কাম্য; তাও নিন্দিত হয়ে দৈশিক-রাষ্ট্রিক ঐক্য হচ্ছে বন্দিত। এর পরে আসবে আন্তর্জাতিক ঐক্যের আহ্বান। এমনি করে জীবন-জীবিকার সবক্ষেত্রেই আসে পরিবর্তন ও বিবর্তন। জীবনের বিকাশ-ধারায় প্রয়োজন। প্রয়াসের সমন্বিত প্রেরণায় রূপান্তর আসছে মনে-মেজাজে। তাই পালটাচ্ছে ভাব, চিন্তা ও কর্ম, বিবর্তিত হচ্ছে আচার ও আচরণ, শিল্প ও সাহিত্য, রুচি ও হিত, নীতি-চেতনা ও জীবনদৃষ্টি।
বৈপরীত্য ও অসঙ্গতি থেকেই বৈচিত্র্যের উদ্ভব। জীবনের ও সমাজের বিচিত্র বিকাশ এতেই হচ্ছে সম্ভব। যারা চিরকালের জন্যে জিয়নকাঠি আবিষ্কারের উৎসুক, তাদের কামনা তাই কখনো পূর্ণ হবে না। ধ্রুবতাকামীরা স্বল্পবুদ্ধি। চলমানতাই জীবন, গতিশীলতাই জিয়নকাঠি। মানুষের বিকাশ-সম্ভাবনা দিগন্তহীন নিঃসীম।
প্রজ্ঞা
শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষকে সংবাদের সিন্দুক করা নয়, সুন্দর ও সুস্থ জীবন রচনায় প্রবর্তনা দেয়া, সফল সার্থক জীবনযাত্রার পথ ও পাথেয় দান। তেমনি জীবনযাত্রা সুখকর করবার জন্যে প্রয়োজনীয় কৌশল উদ্ভাবনে এবং দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনেই বৈজ্ঞানিক প্রয়াস নিয়োজিত। পার্থিব জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজন মিটানো ও নিরাপত্তা সাধনই বিজ্ঞানের কর্তব্য। কিন্তু মনোভূমে কল্যাণ-লক্ষ্যে প্রীত, করুণা ও মৈত্রীর চাষ করা এবং ফসল ফলানো হচ্ছে বিবেকী আত্মার দায়িত্ব।
বিজ্ঞানচর্চার মূলে রয়েছে স্বাধীন চিন্তা ও জিজ্ঞাসা। এ অন্বেষা প্রসারিত করে বহির্দষ্টি। এর নাম জ্ঞান। জ্ঞান শক্তি দান করে এবং শক্তি প্রয়োগেই আসে ব্যবহারিক জীবনে সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্য। যন্ত্রশক্তি তাই আজ অজেয় ও অব্যর্থ। কিন্তু ব্যবহারিক-বৈষয়িক জীবনযাত্রা বাঁচা নয়, বাঁচার উপকরণ মাত্র। কেননা, মানুষ বাঁচে তাঁর আনন্দে ও যন্ত্রণায় অর্থাৎ অনুভবের মধ্যে। সে অনুভবকে সুখকর সম্পদে পরিণত করতে হলে চাই প্রজ্ঞা–যে প্রজ্ঞা কল্যাণ ও সুন্দরকে প্রীতি ও মৈত্রীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা-প্রয়াসী।
বিজ্ঞানের প্রয়োগ-ক্ষেত্রে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার, প্রযোজন ও প্রীতির সমতা রক্ষিত না হলে আজকের মানুষের প্রয়াস ও প্রত্যাশা ব্যর্থতা ও হতাশায় অবসিত হবেই। কেবল তা-ই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিহিংসা জিইয়ে রাখবে দ্বন্দ্ব-সগ্রাম ও সংঘর্ষ-সংঘাত। রাসেল তাই বলেছেন–বিজ্ঞান-লব্ধ শক্তিকে সুপথে চালিত করার সুমতি নেই বলে মানুষ আজ ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
অতএব, আজ যন্ত্রের সঙ্গে জানের, কালের সাথে কলিজার, মেশিনের সাথে মননের, বলের সাথে বিবেকের নিকট ও নিবিড় যোগ থাকা আবশ্যিক। নইলে মানবিক সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। মানবকল্যাণে প্রাপ্তির সাথে প্রীতির, জ্ঞানের সাথে প্রজ্ঞার, বিজ্ঞানের সঙ্গে বিবেকের সমন্বয় ও সমতা সাধনই আজকের মানববাদীর গুরু দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য।
শিক্ষা
শাস্ত্রের সঙ্গে শিক্ষার বিরোধ ঘুচবার নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন। কেননা জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানমাত্রই বর্ধিষ্ণু। কারণ, জিজ্ঞাসা থেকেই জ্ঞানের উৎপত্তি। জিজ্ঞাসা অশেষ, তা-ই জ্ঞানও কোনো সীমায় অবসিত নয়। বিদ্যা জ্ঞান দেয়। নব নব চিন্তা-ভাবনায় ও আবিক্রিয়ায় জ্ঞানের পরিধি পরিসর কেবলই বাড়ছে। যত জানা যায়, তার চেয়েও বেশি জানবার থাকে। জ্ঞান বৃদ্ধির অনুপাতে তথ্যের স্বরূপ ও তত্ত্বের গভীরতা ধরা পড়ে। এজন্যে জ্ঞানের সাথে ধর্মশাস্ত্র সমতা রক্ষা করতে অসমর্থ।
ধর্মশাস্ত্রীয় সত্য হচ্ছে চিরন্তনতায় ও ধ্রুবতায় অবিচল। তার হ্রাস নেই, বৃদ্ধি নেই, বদল নেই, নেই পরিবর্তন ও পরিমার্জন। পক্ষান্তরে জ্ঞান হচ্ছে প্রবহমান, তার উন্মেষ আছে, বিকাশ আছে, প্রসার আছে, আছে তার বিবর্তন ও রূপান্তর। নতুন তথ্যের উদ্ঘাটন, নব সত্যের আবিষ্কার পুরোনো জ্ঞানকে পরিশোধিত ও পরিবর্তিত করে। যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে চাঁদ-সূর্য সম্পর্কে তথ্যগত ও তত্ত্বগত সত্যের রূপান্তর ঘটেছে ও ঘটছে এবং জিজ্ঞাসু মানুষ তা দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করেছে ও করছে। কিন্তু শাস্ত্রীয় চাঁদ-সূর্য সম্পর্কে প্রত্যয়জাত সত্যের কোনো পরিবর্তন নেই বেদে-বাইবেলে। জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসের বিরোধ এখানেই। জ্ঞান প্রমাণ-নির্ভর আর বিশ্বাস হচ্ছে অনুভূতি-ভিত্তিক। জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়জ আর বিশ্বাস হচ্ছে মনোজ। চোখ-কানের সাক্ষ্য মানুষ কত সহজেই না অগ্রাহ্য করে! আর মনের দাবী পূরণে কত উৎসুক সে! তার কাছে জ্ঞান অপরিহার্য আর বিশ্বাসই শিরোধার্য। চিত্তলোকে আজো মানুষ জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাসের অরণ্যে পথের সন্ধানে দিশহারা।
সংস্কৃতির মুকুরে আমরা
পরিশীলিত ও পরিস্রত জীবনচেতনাই সংস্কৃতি। কুসুমের মতো বিকশিত হয়ে উঠে সংস্কৃতিবান মানুষের মন। তার আত্মার লাবণ্য তার আচরণ ও কর্মকে দেয় মাধুর্য। তার কৃতি পরিবেশকে করে স্নিগ্ধ ও সুন্দর। তার মনের রঙে ও প্রীতির সুবাসে জগৎ-সংসারের মানুষ মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়। সংস্কৃতির অপর নাম তাই সৌন্দর্য-অন্বেষা। যা কিছু কুৎসিত ও অসুন্দর তা দেখা, শোনা, বলা ও করা থেকে বিরত থাকাই সংস্কৃতিবানতা। তাই সৌজন্যেই সংস্কৃতির পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে উঠে। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও কল্যাণবুদ্ধি সংস্কৃতির পরিবর্ধক।