মুক্তির উপায়-লব্ধ-প্রত্যয় ও প্রথা পরিহারের অঙ্গীকারে অর্জিত জ্ঞান, উদ্ভূত প্রজ্ঞা ও অনুশীলিত বিবেকের প্রাধান্য দান। তাহলেই কেবল আত্মায় ও আত্মীয়ে, স্বভাবে ও সংসারে, প্রজ্ঞায় ও প্রত্যয়ে, জীবনে ও জগতে, বিদ্যায় ও বিশ্বাসে, বিবেকে ও বিষয়ে দ্বন্দ্ব ঘুচবে। নৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক কিংবা বৈষয়িক জীবনে বিরোধ ও বিবাদ কমবে–অন্তত তা তার জীবন-বিনাশী প্রাবল্য হারাবে।
সততা
সততা তিন প্রকার: পাপভীরুতা জাত, পার্থিব শাস্তিভীরুতা জাত এবং আত্মসম্মান ও আদর্শ প্রসূত। প্রথম দুটো সাহসের অভাবজনিত। আর তৃতীয়টি যথার্থ চরিত্রবলের অবদান। প্রথম দুটোর সামাজিক প্রভাব সামান্য, কেননা ঐরূপ সততা ব্যক্তিত্ব দান করে না। শেষোক্তটির প্রভাব সামাজিক মানুষের নৈতিকচরিত্র উন্নয়নের সহায়ক। কেননা, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন তেমন মানুষের ব্যক্তিত্ব তার চারদিককার মানুষকে প্রভাবিত করে এবং তাকে অনুসরণের প্রেরণা দেয়। এমন মানুষের সততা নির্ভীকতাপ্রসূত এবং তা ক্ষতি স্বীকারের ও যন্ত্রণা সহ্য করবার শক্তিদান করে। এমন সতোর ভিত্তি নির্লোভ, আদর্শচারিতা ও মর্যাদা-চেতনা। পাপ ও কলঙ্কভীরুতা একপ্রকার Negative ব্যক্তিত্ব, পক্ষান্তরে নিজের মর্যাদা-চেতনা একটি Positive গুণ।
পাপ-ভয় কিংবা নিন্দা-কলঙ্ক-শাস্তি ভয় জাগিয়ে মানুষকে সৎ রাখা সহজ নয়। বিশেষ বয়সে প্রবল প্রলোভনের তোড়ে পাপ-ভয়জনিত সততা স্রোতের মুখে কুটোর মতোই ভেসে যায়। আর গোপনে অপকর্ম করে সহজেই নিন্দা-কলঙ্ক-শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি মেলে। যখনই সুযোগ মিলবে, সতোর মুখোশ পরিহার করতে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হবে না। সামাজিক জীবনে সততা স্থায়ী করতে হলে পাপ ও নিন্দা-ভীরুতার ভঙ্গুর বাঁধনে আস্থা রাখা চলবে না। মানুষের অতীত ইতিহাসই তার সাক্ষ্য। কেবল মর্যাদাবোধের দৃঢ় ও ধ্রুব ভিত্তিতেই সতোর অনুশীলন ও প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আর আইন ও শাসনের কঠোরতায় কোনো স্থায়ী ফল মেলে না। ওটি আপাত উপশমের উপায়মাত্র। . আসলে সমাজে প্রতিষ্ঠাকামী না হলে মানুষের মনে সততা-প্রীতি স্থায়ী হয় না। এজন্যে কিছু শিক্ষা, কিছু আর্থিক স্বাচ্ছল্য এবং সমাজে গণ-জীবন উন্নয়নের ও বিকাশের কিছু সুযোগ থাকা প্রয়োজন। সামন্ত-প্রধান সমাজে তা ছিল প্রায় অনুপস্থিত। বুর্জোয়া সমাজে ধনের ও পদের মর্যাদা আর সর্বপ্রকার মূল্যবোধকে ছাপিয়ে উঠে বলে সেখানেও সতোর সুপ্রসার সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই মানুষের সততা ও আদর্শ-চেতনা প্রবল ও প্রকট হয়ে উঠতে পারে। কাজেই নৈতিক জীবনের মানোন্নয়নকামীরা অন্য উপায়ে অভীষ্ট ফল পাবেন না। কেবল সাফল্য মরীচিকায় আশ্বস্ত থাকবেন মাত্র।
নিঃস্ব লোকের আকাক্ষা প্রয়াস-প্রেরণা যোগায় না–তা বন্ধ্যা। তেমন লোক প্রাণে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় থাকে, পাপ-পুণ্য কিংবা নিন্দা-লজ্জামানের কথা ভাবে না। তা তার পক্ষে অসম্ভব ও অনর্থক জেনেই সে উদাসীন কিংবা বেপরওয়া। সমাজে প্রতিষ্ঠা যে পাবেই না, সে কেন নিন্দা লজ্জার ভয় করবে? সৎপথে যার জীবিকা অর্জন সম্ভবই নয়, পুণ্যের প্রত্যাশা তার ত্যাগ করতেই হবে। অতএব ধর্ম বল, নীতিবোধ বল, পুণ্য বল আর মান বল, সবই আর্থিক স্বাচ্ছল্য ও সামাজিক, প্রতিষ্ঠা-বাঞ্ছা থেকেই উৎসারিত।
সাহিত্য
মানুষের জীবন-চেতনার ও জীবন-চর্যার পরিচয় তার আচরণে, সাহিত্যে, শিল্পে, সঙ্গীতে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে অভিব্যক্তি পায়। সে-প্রকাশ কখনো অকৃত্রিম হয় না। কেননা সমাজবদ্ধ প্রতিটি মানুষই নানা অদৃশ্য বন্ধনের বান্দা। তার জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় দেশ, কাল, ধর্ম, আচার, বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতির প্রভাবে। তাই মানুষের মন ও মেজাজ, লোভ ও ক্ষোভ, ন্যায় ও অন্যায়বোধ, রুচি ও শ্রেয়োচেতনা স্থান-কাল-পাত্র সংপৃক্ত ও আপেক্ষিক। কখনো স্বার্থচেতনা, কখনো হিতবোধ, কখনো গৌত্রিক স্বার্থ, কখনো জাতিক আদর্শ, কখনোবা মানবিক-চেতনা প্রবল হয়ে মানুষের চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে।
ষড়রিপুর প্রেরণায় যেমন সে পরিচালিত, তেমনি কোনো আদর্শ এবং নৈতিক দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধও তাকে চিন্তায় ও কর্মে প্রবর্তনা দেয়। ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয়ের বিপরীতমুখী আকর্ষণেও মানুষের ভাব-চিন্তা-আচরণে দ্বান্দ্বিক অসঙ্গতি প্রমূর্ত হয়ে উঠে। এজন্যে সামাজিক মানুষের জীবন চেতনা ও জীবনযাত্রা দ্বান্দ্বিক অসঙ্গতির সমষ্টি মাত্র। তার জৈব স্বভাব তাই কখনো স্বরূপে প্রকাশ পায় না।
এজন্যেই মানুষের চেতনায় কিংবা জীবনাচারে কোনো চরম ও ধ্রুব সত্যের প্রকাশ ও বিকাশ নেই। সব সত্যই সাময়িক। সব শ্ৰেয়োবোধই পারিবেশিক। এরই ফলে মানুষের সাহিত্যে, সমাজে, ধর্মে, আদর্শে, নীতিবোধে, শিল্পকলায় কোনো চিরন্তন ও সর্বমানবিক সত্যের উপলব্ধি ও প্রকাশ নেই। তাই, ধর্ম, সমাজ, আদর্শ, নীতিবোধ, সাহিত্য ও শিল্পকলা স্থানে স্থানে এবং কালে কালে রূপ বদলায়, রঙ বদলায়, বদলায় টঙ, বদলায় ভাষা, বদলায় বক্তব্য।
এ্যডাম-ডেভিড-সলোমনের কালে কিংবা মহাভারতীয় যুগে অথবা গ্রীকপুরাণে নারী সম্বন্ধে চেতনা ছিল একরকম, পরে হয়েছে অন্যরকম। সে-যুগে রাবণেরা সীতা হরণ করেই-হত বীর, পরের যুগে নারীর রূপ-বহ্নিই জ্বালিয়েছে দেবলোক, পুড়িয়েছে সমাজ-সংসার। আজো কুমারীর রূপমুগ্ধতাই প্রেম আর পরস্ত্রীর রূপানুরাগ কাম। তাই বহুপত্নীক রত্নসেনেরা প্রেমিক ও নায়করূপে প্রশংসিত আর আলাউদ্দীন-দেবপালেরা কামুক বলে নিন্দিত। আজকাল বিবাহিত পুরুষের কুমারী রূপানুরাগও কাম বলে ঘৃণিত। রমা-রোহিণী-সাবিত্রীরা যদি হিন্দু না হত, তাহলে তাদের বৈধব্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াত না।