যন্ত্রায়ত জীবিকার ফলে উদ্ভূত জীবন-প্রতিবেশে আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ আজ আর আগের মতো আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে না। সে এখন দৈব-নির্ভর নয়, রোদ-বৃষ্টি-রোগ-অন্নের জন্যে ভাগ্যের উপর ভরসা রাখে না। সে বুঝেছে এতে প্রকৃতির প্রভাব যতটুকু, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি রয়েছে মানুষের হাত। মানুষের লোভ, স্বার্থপরতা ও অপ্রেম-অবিবেচনাই মানুষের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর কারণ। কাজেই স্বায়ত্ত জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, সুষ্ঠু বিন্যাস ও সুনিয়ন্ত্রণের কথাই সে সর্বক্ষণ ভাবছে, না-ভেবে পারছে না। তার অন্ন চাই, আনন্দ চাই, ওষুধ চাই, প্রবোধ চাই। প্রাচুর্যহীন কাড়াকাড়ির যুগে তাই মানুষকে শোষণ, পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তারা অক্ষম বলেই তাদের সৈনাপত্য নিয়েছে সংবেদনশীল মানববাদী লোকসেবক, লেখক, গায়ক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি সবাই। এই লড়িয়ে লোকগুলোই স্ব স্ব ক্ষেত্রে লড়াই করে যাচ্ছে মানুষের মুক্তির জন্যে। তারা মুক্তি কামনা করে শোষণ থেকে, অশিক্ষা থেকে, দৈন্য থেকে, বিশ্বাস থেকে, সংস্কার থেকে, পীড়ন থেকে, অন্ধকার থেকে, অজ্ঞতা থেকে, অমঙ্গল থেকে, হীনমন্যতা থেকে।
এদের মধ্যে যারা লিখিয়ে তারা গণসাহিত্যিক, যারা নেতৃত্ব দেয় তারা গণনেতা, যারা আঁকে তারা গণশিল্পী, যারা চিন্তাবিদ তারা মানববাদী, যারা ঐতিহাসিক তারা সমাজতাত্ত্বিক। এ সংগ্রাম চলছে লেখা ও রেখার, কথা ও সুরের মাধ্যমে। তারা লিন্দু শোষক ও পীড়কদের মনের কাছে, মস্তিস্কের কাছে, বিবেকের কাছে এ আবেদনই জানাতে চাচ্ছে যে–পরিণামদর্শী হও, বিবেকবান হও এবং সংবেদনশীল হও, আর আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই যৌথ জীবনের সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি সমভাবে ভাগ করে নিতে এগিয়ে এসে, নইলে নিষ্কৃতি নেই তোমার–যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে টানিছে যে নীচে। সমস্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতা ও সহঅবস্থানে রাজি হতেই হবে। এরই নাম গণসাহিত্য, গণসংগীত ও গণশিল্প। কাজেই গণশিল্প-সাহিত্য, শোষিত-পীড়িত অন্ধ-অশিক্ষিত চাষী-মজুরের জন্যে নয়, পীড়ক-শোষক লিন্দু বেনে বড় লোকের উদ্দেশ্যেই রচিত।
আমার লেখায় ও রেখায়, আমার কথায় ও সুরে আমার জীবনের চাহিদার দাবি; আমার ভাত-কাপড়ের, আমার তেল-নুন-লাকড়ির, আমার ওষুধ-পথ্যের অভাবের কথাই অভিব্যিক্ত পাবে। কেননা এ অভাব আমাকে সর্বক্ষণ ঘিরে রয়েছে, আমার জাগ্রত মুহূর্তগুলো বিষিয়ে তুলেছে; আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। যন্ত্রণার প্রকাশপথ রুদ্ধ করা সহজও নয়, স্বাভাবিকও নয়। এই যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ও তার নিরসনের আবেদন ও আকুতিই গণশিল্প-সাহিত্য বা সঙ্গীত। অভাবজীর্ণ পাঁজর থেকে এ ছাড়া আর কী আশা করা যায়! আজো তকদির-বাদী ও নিয়ন্ত্রিত জীবনে যারা আস্থা রাখে আর যারা অন্যের শোণিত পানে পুষ্ট, অথচ যাদের সংবেদনশীলতা কিংবা পরিণামদর্শিতা নেই, কেবল তাদের মুখেই আমরা শুনতে পাই আদ্যিকালের ফুল-পাখি ও প্রেম-প্রকৃতির মহিমা কীর্তন।
এ শতক মানুষের মুক্তির বাণী বয়ে নিয়ে এসেছে। অজ্ঞতা থেকে, দাসত্ব থেকে, পরাধীনতা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, লিপ্সা থেকে, অমানুষিকতা থেকে প্রত্যহ মুক্তি আসছে কারো-না-কারো, কোথাও-না-কোথাও। অতএব শতাব্দীর আহ্বান ব্যর্থ যাবে না। আলো ঝলমল আনন্দঘন সুপ্রভাত আসন্ন। সামনে নতুন দিন।
সংস্কার-সততা-সাহিত্য-প্রজ্ঞা-শিক্ষা
ধর্ম বলতে সাধারণে যা বোঝে তা এমন একটি সংবিধান, বুদ্ধিমানের দ্বারা প্রবর্তিত আর নির্বোধ দ্বারা অনুসৃত। এ এমন একটা idea দেয়, এমন একটা চেতনা দান করে যা শৈশবে, বাল্যে ও কৈশোরে–প্রত্যয়ের ও প্রথার, বিশ্বাসের ও ভরসার, স্বস্তির ও সংস্কারের এক অক্ষয় পাথুরে কেল্লা নির্মাণ করে। সামুক-কুর্মের দেহাধারের মতোই এটি মানুষের সংস্কারার্জিত চেতনাকে সারাজীবন সযত্নে রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করে।
ফলে অতিক্রান্ত কৈশোরে মানুষ যা-কিছু দেখে বা শুনে, তা ঐ কেল্লার বাইরে মরিচার মতো, ধূলিস্তরের মতো কিংবা আবরণ-আভরণের মতোই সংলগ্ন থাকে মাত্র, চেতনায় সমন্বিত হয় না। এজন্যেই অর্জিত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান, উদ্ভূত প্রজ্ঞা মানুষের বৈষয়িক জীবনে কেজো বটে, কিন্তু অন্তৰ্জীবনে ব্যর্থ।
ব্যবহারিক জীবনে বিদ্যা-জ্ঞান-প্রজ্ঞার উপযোগ ও প্রয়োগসাফল্য প্রত্যক্ষ। তাই এগুলো সর্বথা ও সর্বদা বহুল প্রযুক্ত। কিন্তু অন্তৰ্জীবনে–ভাবলোকে এগুলো প্রবেশপথ পায় না। তাই মানুষের এতকালের জ্ঞান-গবেষণা, বিদ্যাবত্তা ও প্রজ্ঞা-প্রদীপ মানুষের বৈষয়িক জীবনে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য ও সাফল্য দিয়েছে, তার সিকি পরিমাণও বিস্তৃত কিংবা ভাস্কর করেনি অন্তর্জগৎ। সেজন্যে আজো মানুষ প্রাণের পরিচর্যাই কেবল করে, বিবেকের অনুশীলনে উদ্যোগী হয় না। ফলে মন-রথীর বিবেক-সারথি ছিন্ন-বল্প অশ্বের প্রতীয়মান নিয়ন্তামাত্র। তাই জগৎ-সংসার এক বিরাট বিচিত্র খেদার রূপ নিয়েছে। বাহ্যত সব বাঁধনই যেন ফসূকে গেরো, কিন্তু তবু মুক্তি অসম্ভব। খেদায় হাতীর বল-বীর্য-বুদ্ধি কোনটাই কাজে লাগে না। প্রথম জীবনে ঘরোয়া পরিবেশে নির্মিত প্রত্যয়ের এবং প্রথার খেদায়ও মানুষের অর্জিত বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা মানুষের মুক্তির সহায় হয় না। অনুগত হাতীর পীড়নে বুনো হাতীর জীবন যেমন পারবশ্যতায় অপচিত, তেমনি পুরোনো সমাজ সংস্কারের আনুগত্যে ভূমিষ্ঠ মানুষ পোষাপ্রাণীর যান্ত্রিক জীবন-ভাবনায় বিড়ম্বিত।