.
০৬.
নইলে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অনেকেরই মনঃপূত নয়। সমস্বার্থে মিলন অসম্ভব নয়। বটে, তবে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা যে আর্থিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও জীবনধারণ পদ্ধতির পার্থক্য ঘটায়, তাতে আধুনিক রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাও নিতান্ত কৃত্রিম ও অকেজো হয়ে পড়ে। এ কারণে, একক রাষ্ট্র-গঠনে কিছুসংখ্যক লোকের আপত্তি গোড়াতেই শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তখন সাফল্য ও প্রাপ্তির উল্লাস বশে কেউ স্বস্থ ছিল না, তাই এ সদ্বুদ্ধি তখন পাত্তা পায়নি।
বাঙালির সর্বাত্মক স্বাতন্ত্র্য ও স্বার্থ রক্ষিত হোক, তা আমাদেরও কাম্য। কিন্তু তা জনস্বার্থে ও জনকল্যাণের জন্যেই হওয়া চাই,অবাঙালি বুর্জোয়াকে তাড়িয়ে বাঙালি বুর্জোয়ার সুবিধে করে দেবার জন্যে নয়। আগে একবার বেরাদরানে ইসলাম-এর মোহে পড়ে ঠকেছি, আবার বাঙালি ভাইয়ের মমতায় পড়ে প্রতারিত হতে চাইনে। স্বার্থের জন্যে আমরা বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে দ্বিধা করিনে। বাঙালি ভাইকে পুঁজিপতি ও ধনপতি করবার জন্যে নিজের প্রাণ দেবার মতো নির্বোধ থাকা এ-যুগে নৈতিক অপরাধ ও শোচনীয়রূপে বেদনাকর। জনগণের এমনি অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্যের সুযোগে চিয়াঙকাইশেকরা চীনে রাজত্ব করেছিল; স্বদেশী স্বজাতি বেরাদরের শোষণ থেকে গণমানব মুক্তি খুঁজেছিল অন্য পন্থায়। চিয়াঙকাইশেকরাও সেদিন গণস্বার্থ রক্ষার ভাওতা দিয়ে বিদেশী বিতাড়নে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে হয়েছিল গণনেতা। তারপর ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
আর গণমানবেরা দেখল তারা প্রতারিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত এবং স্বদেশী ও বিদেশী শাসনে পার্থক্য নগণ্য। স্বদেশী বা বিদেশী শাসন এ-যুগে বড় সম্পদ বা সমস্যা নয়, এ-যুগে বঞ্চক বঞ্চিত সম্পর্ক সব সমস্যার মূলে। বঞ্চিত জনের কল্যাণ চিন্তাই, তার শোষণ ও দারিদ্র মুক্তিই এ যুগের রাষ্ট্র-ভাবনার একমাত্র বিষয়। বুর্যোয় স্বার্থের সংগ্রামকে গণ-সংগ্রাম বলে চালিয়ে দেয়ার দিন অপগত-প্রায়–এই প্রত্যয় নিয়ে মানুষের রাষ্ট্র-সাধনা ও রাজনৈতিক সংগ্রাম গণ-মুক্তি ও গণ কল্যাণে নিয়োজিত হবে–এই আশ্বাসে ও অঙ্গীকারে আমরা সুদিনের প্রতীক্ষারত।
শিল্প-সাহিত্যে গণরূপ
জীবন আছে অথচ প্রয়োজন নেই, এমন হতেই পারে না। আমি আছি বলেই আমার ভুবন আছে। আমার জীবন সেই ভুবনের সঙ্গে একই নাড়িতে যুক্ত, একই সূত্রে গাঁথা। আমার জীবনের তুচ্ছ উচ্চ সর্বপ্রকার প্রাত্যহিক কিংবা মৌর্তিক প্রয়োজন আমার ভুবনই মিটায়। আমি আছি তাই আমার পেটের ভাত, পরনের কাপড়, রোগের প্রতিষেধক, শোকের প্রবোধ, দেহের পুষ্টি ও মনের তুষ্টির দরকার। রুচি বদলের জন্যে আমি বন্ধনে মুক্তি, যন্ত্রণায় আনন্দ, সমস্যায় সমাধান যেমন সন্ধান করি; তেমনি কখনো কখনো মুক্তি এড়িয়ে বন্ধনকে, আনন্দকে হেলা করে যন্ত্রণাকে, সম্পদ ছেড়ে সংকটকে বরণ করে জীবনের অন্য স্বাদ খুঁজি।
জীবন আমার কাছে কখনো দায়িত্ব, আর কখনো বিলাস, কখনো দায়, কখনো সম্পদ, সকালে আনন্দ আবার সন্ধ্যায় যন্ত্রণা, কখনো খেলনা কখনো ঐশ্বর্য, কখনো বোঝা, কখনো পাথেয়, কখনো বেদনা, কখনো বা আকুতি, কখনো প্রাণময়, কখনো মনোময়, কখনো রূঢ়িক, কখনো সামাজিক, কখনো বৈষয়িক, আবার কখনো বা দার্শনিক। সবটা মিলে জীবন এক অনন্য অনুপম দুর্লভ ঐশ্বর্য। এই জীবনের স্বাদ যে একবার সচেতনভাবে পায়, সে আনন্দলোকেরই সন্ধান পায়। জীবন-ধনে যে ধনী, তার কাছে নিখিল জগৎ রূপবান হয়ে অপরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়। সেই রূপসী ধরণীর অনুরাগে তার স্বভাবে আসে কমনীয়তা, তার হৃদয়ে জাগে ঔদার্য, প্রীতির সঞ্চয়ে ভরে উঠে তার বুক। চিত্তলোকে তার গড়ে উঠে মাধুর্যের মৌচাক। তখন সে প্রীতি ও শুভেচ্ছার পুঁজি নিয়োগ করে। তার ভুবনে। বিনিময়ে পায় মানুষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। জীবনে এর চেয়ে বড় সম্পদ, এর চেয়ে কেজো পাথেয় আর নেই। মানব জমিন আবাদ করলে যে ফসল মেলে, তা কখনো নিঃশেষ হয় না–বন্ধ্যা হয় না।
মন-প্রাণের এমনিধারা অনুশীলনের নামই সংস্কৃতিচর্যা, আর এ স্তরে উত্তরণই সংস্কৃতি। এমনি করে সংস্কৃতিবান হলেই মানুষ হয় প্রীতিপরায়ণ, সংবেদনশীল, পরিণামদর্শী ও কল্যাণপ্রবণ। কেননা, সে বোঝে–নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না, একে নষ্ট করলে সবাই দুঃখ পায়। এমন মানুষ অনুকম্পা বশে উদার হয় না, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে মহৎ হয়। তেমন মানুষ বাদশা কিংবা ফকির হতে পারে, চালু অর্থে মূর্খ কিংবা জ্ঞানী হতে পারে, নিরক্ষর কিংবা বিদ্বান হতে পারে। কিন্তু তাতে তার মানবিক চেতনায়, তার প্রীতিশীলতায়, তার হিতবুদ্ধিতে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। অবশ্য তা ব্যক্ত হওয়া কিংবা অব্যক্ত থাকা, তার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে তার সামাজিক, শৈক্ষিক, আর্থিক ও ধার্মিক প্রতিবেশের উপর। কিন্তু তাতে তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বের ঔজ্জল্য কমে না, বরং অবরুদ্ধ আবেগের বেদনায় তপ্ত কাঞ্চনের মতো–কষিত সুবর্ণের মতো তার রূপ, তার লাবণ্য বাড়ে।
এমন মানুষ যখন লোকসেবায় নামে তখন সে বুদ্ধ-যীশু-কবীর-নানক-চৈতন্য-বায়যিদ হয়, যখন নৃপ হয় তখন ইউসুফ-রাম-নওশেরোয়া হয়। যখন লিখিয়ে হয় তখন শেপীয়র ভল্টসয়ার গ্যটে-টলস্টয়-লা-রবীন্দ্রনাথ হয়। যখন গাইয়ে-বাজিয়ে হয় তখন তানসেন-হরি বৈজু-বিটোফন হয়। যখন আঁকিয়ে-বানিয়ে হয় তখন ভিঞ্চি-এ্যাঞ্জেলো-পিকাসো হয়– তখন আমরা পাই অজন্তা ইলোরা-এথেন্স-আগ্রার ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও আলেখ্য। যখন দার্শনিক হয় তখন তার মধ্যে প্ল্যাটো এ্যারিস্টোটল-রুশদ-হেগেল-নীৎসে-সার্জেকে পাই। যখন সমাজতাত্ত্বিক হয় তখন সেন্ট অগাস্টাইন খলদুন-মার্কসকে পাই। যখন বিজ্ঞানী হয় তখন ডারউইন-ফ্রয়েডকে পাই। যখন বিপ্লবী হয় তখন লেনিন-মাও-গুয়েভারাকে দেখি। এ যুগে যন্ত্র-প্রভাবে মানুষের জীবিকা ও জীবন-পদ্ধতি পালটে গেছে। তাই যুগ-প্রয়োজনে গণচেতনা, গণসাহিত্য ও গণতন্ত্রের কথাই প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রায় সর্বক্ষণ শুনতে হয় আমাদের।