.
০৪.
ব্রিটিশ যুগে কিছুসংখ্যক বর্ণহিন্দু চাকুরে-মহাজন-জমিদার বাঙলার অর্থ-সম্পদ করায়ত্ত করে। বর্ণ ধর্ম অবিশেষে আর সব বাঙালিই ছিল নির্জিত, শোষিত ও নির্যাতিত। ইংরেজি শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত বর্ধিষ্ণু মুসলিম সমাজ দেশের ধন-সম্পদে, বাণিজ্যে ও চাকুরিতে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে ওদের প্রতিপক্ষতা শুরু করে। এ ছিল স্বস্বার্থে সমশ্রেণীর প্রবল শোষকের বিরুদ্ধে দুর্বল বঞ্চিত শোষকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এর মধ্যে গণ-কল্যাণের কোনো অভিপ্রায় ছিল না। চাকুরি-সদাগরী জমিদারীতে শিক্ষিত মুসলমানের আনুপাতিক হার প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম জনগোষ্ঠী শোষণ ও দারিদ্র্যমুক্ত হত না। যেহেতু চাকুরে-মহাজন-জমিদার ছিল হিন্দু, সেহেতু এইসব উচ্চাভিলাষী মুসলমান স্বধর্মীর অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের সুযোগে স্বস্বার্থে মুসলিম মনে জাতিবৈর জাগাতে সমর্থ হল সহজেই। ফলে শোষক-শোষিত নির্বিশেষ হিন্দুর প্রতি মুসলিম-মনে জাগল ক্ষোভ ও বিদ্বেষ। গণ কল্যাণে যে-সংগ্রাম শুরু হওয়া উচিত ছিল ব্রিটিশ শাসক ও দেশী শোষকের বিরুদ্ধে, তা এভাবে বিধর্মী-বিদ্বেষের রূপ নিল। গণমানবের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগে মুসলিম লীগ গণ-সমর্থনে অর্জন করল পাকিস্তান। যারা পূর্বে ধন-সম্পদ দখলে ছিল হিন্দুর পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী, পাকিস্তানে তারাই হল পরিত্যক্ত ধন-সম্পদ চাকুরির নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন মালিক। জনগণের দুর্ভাগ্য-দুর্ভোগ রইল পূর্ববৎ।
.
০৫.
এদিকে কালক্রমে পাকিস্তান প্রাপ্তির প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে ও উল্লাসে যখন ভাটা পড়েছে, তখন ক্রমবর্ধিষ্ণু শিক্ষিত বাঙালিরা দেখছে তারা অর্থ-সম্পদের সর্বক্ষেত্রে ঠকছে। তাদেরই স্বস্বার্থে তারা আবার পূর্বতন নীতিরই অনুবর্তন কামনা করছে রাজনীতিক্ষেত্রে। তারা দেখছে চাকুরি ও ব্যবসা ধনাগম, ও মর্যাদার এই দু-ক্ষেত্র তাদের হাতছাড়া, সেখানে প্রবেশাধিকার বর্তমান অবস্থায় একরকম অসম্ভব। পাকিস্তান যখন হল তখন সামরিক বিভাগে বাঙালি ছিলই না, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও পদস্থ বাঙালি মুসলিমান ছিল নেহাত নগণ্য। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের ছিল অনীহা ও আর্থিক অসামর্থ্য। বিশেষ করে হিন্দু-বিদ্বেষজাত বেরাদরী উদারতা বশে তখন বাঙালিরা ন্যায্য প্রাপ্য দাবি করেনি। না-পেয়েও তারা পাওয়ার আনন্দে ছিল অভিভূত। আগে জাতি- দ্বেষণাবশে তারা ছিল বেরাদরী-ভাবে বিভোর। ইদানীং দারিদ্র্য, শোষণ ও হতবাঞ্ছার আঘাতে শিক্ষিত বাঙালি আবার স্বাধিকার সংগ্রামে অবতীর্ণ। আগে গণসমর্থন লাভের জন্যে তাদের অবলম্বন হয়েছিল হিন্দু দ্বেষণা, এখন তারা উত্তেজনা দানের ইন্ধন করছে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও.ভাষিক স্বাতন্ত্র্যকে। পূর্বে মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ যেমন করে প্রবল হয়েছিল, অবিকল তেমনি ধারায় ও তেমনি যুক্তিতে দানা বাঁধছে উর্দুভাষী-বিদ্বেষ। কেবল প্রতিপক্ষ বদল হয়েছে, উপায় ও উদ্দেশ্য রয়েছে অবিচল। এর মধ্যেও পূর্বেকার ফাঁক ও ফাঁকি উভয়েই বর্তমান।
পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বোম্বাই থেকে আগত মেমন ও ইসমাইলী সম্প্রদায়, সামরিক ও বেসামরিক বড় চাকুরিগুলো রয়েছে পাঞ্জাবী ও উত্তর ভারত থেকে আগত মোহাজেরদের হাতে। মেমন ও ইসমাইলী ধনপতি-পুঁজিপতিদের পরিচয়ও জানে না বাঙালিরা, তারা চোখের সামনে দেখে পাঞ্জাবী বড় সাহেবদের। পশ্চিম পাকিস্তানী বলতে এরা সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান, মোহাজের-ভেদ মানে না, তাদের চোখে সবাই উর্দুওয়ালা ও পাঞ্জাবী। এমনকি বাঙলার বিহারী মোহাজেরেরাও উর্দুওয়ালা বলে বিহারী-পাঞ্জাবী তাদের কাছে সমার্থক।
এখানকার বিহারীদেরও দোষ আছে। ভাষিক ঐক্যের দরুন তারা পাঞ্জাবীদের মনে করে জ্ঞাতি এবং পাঞ্জাবী শাসনকে তারা ভাবে নিজেদেরই শাসন, ফলে ইংরেজ আমলের দেশী খ্রীস্টান। ও এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো তারাও নিজেদের মনে করে শাসকজাত। আর পশ্চিম পাকিস্তানীর স্বার্থ, লাভ ও গৌরবের তারাও যেন অংশীদার। সেজন্যে বাঙলার বিহারী মোহাজেরেরা। রাজনীতিক্ষেত্রে এ অংশের স্বার্থে কিছু তো করেই না, বরং তাদের আনুগত্য থাকে করাচি-লাহোর রাওয়ালপিণ্ডির প্রতি। এভাবে তারা নিজেদেরকে নিজেরাই বিপন্ন করছে। আর মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত উঠতি বাঙালি বুর্জোয়া এবং চাকুরেরাও তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা মানসে পূর্বের মতো এ. সুযোগ গ্রহণ করে উর্দুওয়ালা নামে অভিহিত অবাঙালি মাত্রেরই বিরুদ্ধে অজ্ঞ-দরিদ্র জনগণকে লেলিয়ে দিতে উৎসুক। স্ব-স্বার্থেই এই বিকাশমান বাঙালি সমাজ প্রতিদ্বন্দ্বী অবাঙালি পুঁজিপতি ও চাকুরেদের সম্পদে ও সম্মানে ভাগ বসাতে চাচ্ছে–বাঙালি জনগণের স্বার্থে নয়।
আযাদী-উত্তর যুগে হিন্দু চাকুরে-মহাজন-জমিদার ও ব্যবসায়ীর স্থলে শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণী বসে মজা লুটছে, জনগণের তকদির রয়েছে অপরিবর্তিত। এও তেমনি এক চাল, এখন যেমন বিশ-বাইশটি অবাঙালি পরিবার পাকিস্তানের ধন-সম্পদের মালিক, তখন ছিল তেমনি কয়েকজন হিন্দু-জৈন আগরওয়ালারা। আগে যেমন হিন্দু শোষক শ্রেণীর সঙ্গে লড়তে গিয়ে আপামর হিন্দুর। বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়েছে তারা, এখন আবার তেমনি পুঁজিপতি ও চাকুরে পশ্চিমাদের থেকে সম্পদ-সম্মানের ভাগ আদায় করবার জন্যে আপামর অবাঙালি-দ্বেষণা জাগানোর চেষ্টা চলছে। এর নাম বাঙালির স্বাতন্ত্র্য-চেতনা, নামান্তরে বাঙালির জাগরণ। উঠতি মধ্যবিত্তের স্বার্থে এ আন্দোলন গড়ে উঠছে বলেই এতে আমাদের আপত্তি।