.
০৩.
য়ুরোপীয়দের অন্যান্য উপনিবেশের মতো ব্রিটিশ ভারতেও প্রতীচ্য ভাষা ও বিদ্যার প্রভাবে জাতীয়তাবোধ দানা বাঁধতে থাকে। তবে য়ুরোপে যা ছিল সাধনা ও সংগ্রামলব্ধ, বহির্বিশ্বে তা ছিল অকালে আকস্মিকভাবে অনায়াসপ্রাপ্তি। হঠাৎ করে মধ্যযুগীয় অমানিশা শীত-সকালের কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। এজন্যে কারো মানসিক, সামাজিক, বৈষয়িক, আর্থিক কিংবা শৈক্ষিক প্রস্তুতি ছিল না। তাই গোড়াতে এই প্রভাব বিচিত্র ও বিকৃত হয়ে দৃশ্যমান হল। পণ্যবিনিময়-ভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি আকস্মিকভাবে মৌদ্রিক অর্থনীতির রূপ নিল, প্রতীচ্য বিদ্যায় শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের বিশ্বাস সংস্কারে দেখা দিল দ্বন্দ্ব, শাস্ত্রে ও সাহিত্যে-দর্শনে বিরোধ হল প্রকট, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিক স্থিতি ঘটাল নতুন বিপর্যয়; যন্ত্রচালিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অভাব, পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিদেশী শাসকের শোষণ আনল আয়-ব্যয়ে অসমতা। এক কথায়, মানস কিংবা বৈষয়িক জীবনে কোথাও আর আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষা করা গেল না।
এমনি প্রতিবেশে প্রতীচ্যশিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মনে জাতীয়তাবোধ এবং তজ্জাত জাতিবৈর অঙ্কুরিত হয়। এ জাতি-চেতনা সুষ্ঠু ছিল না। কখনো ভাষিক, কখনো ধার্মিক, কখনো আঞ্চলিক, কখনো প্রাদেশিক এবং কখনোবা ভারতীয় জাতীয়তারূপে তা আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। এগুলোর মধ্যে স্বধর্ম-ভিত্তিক জাতীয়তাই প্রবল ও প্রকট হয়ে উঠে। রামমোহনে-বিদ্যাসাগরে-বঙ্কিমে এবং হিন্দু-মেলায় এই স্বধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ যেমন লক্ষণীয়, তেমনি সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন হালী, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখও ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী।
হিন্দুমনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার অবলম্বন হয়েছিল আর্য, রাজপুত ও মারাঠা ঐতিহ্য আর মুসলমানেরা প্রেরণার উৎস করেছিল আরব-ইরানী পুরাণ ও ঐতিহ্যকে। দেশ-কাল-পরিবেশ চেতনা কারো ছিল না। এভাবে তারা কেবল হিন্দু ও নিছক মুসলমান বনেছিল, অর্থাৎ প্যান হিন্দুইজম ও প্যান ইসলামই ছিল তাদের আদর্শিক জাতীয়তার লক্ষ্য। এমনিভাবে দেশকালের প্রয়োজন অস্বীকার করে তারা অতীতে, বিদেশমুখিতায় ও স্বাতন্ত্রে খুঁজেছে স্বস্তি ও শ্রেয়সকে। কল্যাণের পথ তাদের জানা ছিল না, জানতে চায়নি তারা; তাই কল্যাণ আসেনি, সুখ দেয়ওনি, পায়ওনি, কেবল লাভের ও সুখের মরীচিকায় আত্মক্ষয় করেছে।
তারপর এই শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ব্রিটিশ বিতাড়ন-বাঞ্ছায় কংগ্রেসের ধ্বজা ধরে তারা ময়দানী-মিলনে প্রয়াস পায়। ময়দানী-মিলন বলছি এজন্যে যে তারা আসলে হিন্দু কিংবা মুসলমানই রয়ে গেল, কেবল সমলক্ষ্যে কারখানা শ্রমিকের মতোই সাময়িক স্বার্থে রাজনৈতিক সংগ্রামার্থ মিলন কামনা করেছিল–এ ছিল অনেকটা নীলনদের ধারার মতো। কেননা তারা দেশের সন্তান হিসেবে অভিন্ন সত্তায় ও পরিচয়ে আস্থাবান ছিল না। মুসলিম লীগে ও হিন্দুমহাসভাতেই তাদের চেতনার ও লক্ষ্যের স্বরূপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অতএব, কংগ্রেসী নিবর্ণ জাতীয়তা ছিল অনেকটা ছদ্মরূপ। এবং বিপন্ন খিলাফৎ-প্রীতিই মুসলমানদেরকে কংগ্রেসের সাহায্য প্রত্যাশী করে তোলে। সেই প্রয়োজনের অবসানে: ইংরেজি-শিক্ষিত মুসলমান কংগ্রেস ত্যাগ করে। আর স্বাধীনতাকামী মোল্লা-মৌলভীরা তখনো কংগ্রেসে থেকে যায় হিন্দু প্রীতিবশে নয় অবশ্যই, স্বাধীনতা অর্জনে হিন্দুর শক্তির প্রতি আস্থাবশে। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান চাকুরির ক্ষেত্রে ছিল হিন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই মুসলিম লীগই ছিল তাদের প্রিয়।
ইংরেজি অজ্ঞ মোল্লা-মৌলভীরা চাকুরির প্রত্যাশী ছিল না, তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দুর সঙ্গে হাত মিলাতে পেরেছিল সহজেই। আবার সেকালের পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল নগণ্য, তেমনি দাক্ষিণাত্যে ও মধ্য প্রদেশে মুসলমান ছিল বিরল; রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই ওদের বিধর্মী-সমস্যা ছিল না, বিধর্মী-বিদ্বেষও ছিল না। শেষাবধি ওসব অঞ্চলে কংগ্রেস প্রভাবও ছিল প্রবল। এদিকে তকালীন যুক্ত প্রদেশে চাকুরি ও জমিদারীর অর্থ-সম্পদের অধিকাংশ ছিল। সংখ্যালঘু মুসলমানদের করতলগত, যেমনটি সংখ্যালঘু হিন্দুর ছিল বাঙলা দেশে।
যুক্ত প্রদেশের মুসলমান এই স্বার্থ ও সুবিধা দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্যে সচেষ্ট ছিল। তাদের নেতৃত্বে ও বাঙালির সংগ্রামে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল। মোটামুটিভাবে ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ওহাবী সংগ্রামের অবাসনে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে উত্তর-পূর্ব ভারতে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু-দ্বেষণা ও ব্রিটিশ-প্রীতি প্রবল হতে থাকে। হিন্দু-বিদ্বেষের মূল ছিল সরকারি অনুগ্রহের প্রত্যাশা। অতএব, ১৮৬০ সন থেকে ১৯৪৭ সন অবধি ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানেরা স্বাধীনতা-সংগ্রামী ছিল না, সরকারি সহযোগিতায় হিন্দুর কবল থেকে নিজেদের প্রাপ্য ধন-সম্পদ উদ্ধারেই ছিল ব্রতী। সে ধন-সম্পদ অবশেষে পাকিস্তান রাষ্ট্ররূপে আয়ত্তে এল।
যে ভাগ-বাটোয়ারার দাবী উনিশ শতকের শেষ পাদ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মুসলিম-মনে গুঞ্জরিত হচ্ছিল, তা-ই মুসলিম লীগের মাধ্যমে প্রবল ও ফলপ্রসূ হল। মূলত হিন্দুর জন্যে হলেও কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিল। ব্রিটিশ বিতাড়নে সাফল্য আসে কংগ্রেসের মাধ্যমেই। তার আনুষঙ্গিক ফল পাকিস্তান।