কর্ণট দরবারের ঘরোয়া বিবাদে ইংরেজ ফরাসির সাহায্য কামনা; পর্তুগীজ, আর্মেনীয়, ওলন্দাজ ও ফরাসি কর্মচারীর হাতে দেশীয় রাজন্য কর্তৃক রাজ্যরক্ষার ভারার্পণ; টিপু সুলতানকে ইংরেজের বিরুদ্ধে সাহায্যদানে নিযাম-মারাঠার অস্বীকৃতি; পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ইংরেজকে দিল্লীর সুলতানের দেওয়ানী দান, স্বাধর্মবোধে ভারতের মুসলমান কর্তৃক নাদিরশাহ-আহমদশাহকে মারাঠা দমনার্থে ভারত বিজয়ে প্ররোচনা দান আর নাদিরশাহ-আহমদশাহ কর্তৃক দিল্লী বিজয়, গৃহদ্বারের বিদেশী-বিধর্মী শত্রু ইংরেজকে ছেড়ে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর বালাকোটে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, মীর কাসিম আলির পতনকালে দিল্লীর সম্রাটের ব্রিটিশ পক্ষাবলম্বন, ইংরেজ প্রতিরোধে মারাঠাদের সঙ্শক্তি প্রয়োগে অনীহা, সিপাহীবিপ্লব কালেও দেশী রাজন্যের উচ্ছন্ন-প্রায় ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য প্রভৃতিই সাক্ষ্য দেয় যে রাজা-বাদশাহর দেশ-জাত প্রীতি ছিল না, ছিল কেবল স্বার্থ চেতনা।
তাই সে-যুগের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে রাজা ও প্রজার সমস্বার্থের কোনো মিলন-ময়দান ছিল না। কাজেই রাজার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের, এবং উত্থান ও পতনের লাভক্ষতি ছিল একান্তই রাজার ও রাজ-পরিজনের ব্যক্তিগত দুর্যোগ-দুর্ভোগের বিষয়। এতে প্রজার কোনো ভূমিকা বা হাত ছিল না। রাজ্য ভাগাভাগির জন্যে দ্বন্দ্ব-মিলনে রাজাদের দেশ-জাত ও বর্ণ-ধর্মের বিচার ছিল না; কেবল সম বা বিষম স্বার্থের গুরুত্ব ছিল। তাই দেশী-বিদেশী বা স্বধর্মী-বিধর্মীর পার্থক্য-চেতনা তাদের চিন্তায় ও কর্মে প্রশ্রয় পায়নি। রাজকীয় ব্যাপারে প্রজাদের অধিকার ছিল না বলেই, এক্ষেত্রে তাদের কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না। আর তাই তাদের আনুকূল্য কিংবা প্রতিকূল্যের গুরুত্বও ছিল সামান্য।
পরিণামের পরিপ্রেক্ষিতে পলাশীর যুদ্ধে যে-গুরুত্ব আমরা একালে দিয়েছি, সমকালে এই যুদ্ধের এমনি গুরুত্ব ছিল অভাবিত। ইংরেজ আমলে প্রতীচ্য প্রভাবে লব্ধ জাতীয়তাবাবোধ ও স্বদেশপ্রীতিপ্রসূত এই বোধ আমাদের দেশে অজাতপূর্ব। তাছাড়া স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে আধুনিক সংজ্ঞানুগত দেশ-জাত চেতনার উদ্ভব ছিল অসম্ভব। এ বোধ জাগে অধিকার ও দায়িত্ব-চেতনা থেকে। রাজকীয় ব্যাপারে প্রজার কোনো অধিকার ছিল না, তাই দেশরক্ষার ও দেশবাসী মানুষের হিতচিন্তার দায়িত্ব ছিল না প্রজার। দায়িত্ব-চেতনাই কৰ্তব বুদ্ধি জাগ্রত করে আর কর্তব্যেবোধই উপায় উদ্ভাবনে প্রবর্তনা দেয়। এতেই ঘটে বোধের বিকাশ, এমনি বিকাশের অন্যতম প্রসূন হচ্ছে স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতা। সেদিনকার রাজন্য ও জনগণের চোখে পলাশীর যুদ্ধ ছিল রাজ্য কাড়াকাড়ির আর দশটা যুদ্ধেরই একটি। তাই ইংরেজের সাফল্যে ভারতীয় রাজন্য- সমাজে কোনো চাঞ্চল্য দেখা যায়নি। দিল্লীর দুর্বল রাজা বরং অর্থলোভে অভিনন্দিত করেছেন ইংরেজদের। শুধু কী তাই! পলাশীর পরেও একশ, বছর সময় পেয়েছিলেন ভারতের রাজারা; কিন্তু ক্রমবধিষ্ণু ইংরেজশক্তিকে ঠেকানোর জন্যে তৈরি হননি কেউ। ভারতের পূর্ব প্রত্যন্ত অঞ্চলের পলাশীর যুদ্ধকে এক বছর পরে ইংরেজ কর্তৃক পশ্চিম প্রান্তের পেশোয়ার বিজয়ের জন্যে দায়ী করা চলে না। এ হচ্ছে ছলনার আশ্রয়ে বিবেককে প্রতারিত করে অক্ষমের আত্মপ্রবোধ লাভের অপচেষ্টা মাত্র।
.
০২.
রাজ্য যে রাজার রাজস্ব উসুলের জমিদারী নয়, জনহিত সাধনের জন্যে সমবায় সংস্থামাত্র–এ সত্যের তত্ত্বগত স্বীকৃতির ভিত্তিতে মধ্যযুগের অবসানে গড়ে উঠেছিল য়ুরোপীয় রাজ্য ও রাষ্ট্রগুলো। এমনি রাষ্ট্রচেতনা সহজে আসেনি। উপলব্ধির এই স্তরে উত্তরণের জন্যে সুদীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে। শোষণ, নির্যাতন ও মৃত্যুর শিকার হয়ে অর্জন করতে হয়েছে এ অধিকার। তাজা প্রাণের, নিউঁকি বুকের পলাশ-লাল রক্তের গঙ্গা বয়ে গেছে য়ুরোপে। এ সাফল্য অর্জন-লক্ষ্যে প্রায় চারশ বছর ধরে ধনে-প্রাণে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। মনুষ্য জগতে আধুনিকতা রক্তস্নাত য়ুরোপের দান। চারশ বছরের অনলস অবিরাম সাধনায় লব্ধ এই য়ুরোপীয় জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনা তাদের বহির্বিশ্বস্থ উপনিবেশে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে য়ুরোপীয় ভাষার মাধ্যমে।
তেরো শতকের অন্তিমে দান্তের আবির্ভাব থেকেই মধ্যযুগীয় তমসা তরল হতে থাকে। পেত্রার্ক ছিলেন প্রভাতী পূর্বাশা। এমনি করে য়ুরোপ শাস্ত্রের খাঁচা ডিঙিয়ে সাহিত্য-শিল্পের উদার অঙ্গনে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবে তারা মেরীর চাইতে সত্যকে, যিশুর চাইতে জীবনকে বেশি ভালবাসতে শিখে। এ অঙ্গন যদিও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, তবু ইটালীয় শিল্পী-ভাঙ্কর বিজ্ঞানী লিউনার্দো দ্য ভিনসি, রাফেল, মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ও টাইটিয়ানের নতুন জীবন ও রূপচেতনা; পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৪৫৩ খ্রী.) মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ফলে বাজেন্টাইন গ্রীক বিদ্বানদের য়ুরোপে প্রত্যাবর্তন এবং মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার এ সাধনাকে অপ্রতিরোধ্য ও বেগবান করে তুলল। তারপর নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রভাব প্রসূত reformation ও revolution-এর মাধ্যমে শাস্ত্রীয় Indulgence-এর ফাঁকি ও Inquisition-এর পীড়ন-মুক্ত হয় বহু শতাব্দীব্যাপী নির্যাতিত মানুষ। চারশ বছরব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই মানববাদ, এই শাস্ত্রদ্রোহিতা, এই সৌন্দর্য-অন্বেষা, এই আত্মবিস্তার, এই বিজ্ঞান বুদ্ধি, এই সম্পদ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় প্রভৃতির সামগ্রিক নাম রেনেসাস। ভাষিক, দৈশিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য-চেতনা তথা জাতীয়তাবোধ এই নবযুগের প্রসূন।