রাষ্ট্রিক জাতিচেতনা যে নিতান্ত কৃত্রিম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা রাষ্ট্র ভাঙা-গড়ার সঙ্গে তার জন্ম-মৃত্যু ঘটে। অতএব মানুষে মানুষে মিলনে বাধা কোথায়? আজকের দিনে সরকারি উৎসাহ ও সামাজিক উদারতা থাকলেই দেশে দেশে এ সমস্যার সমাধান কঠিন নয়।
যদি পোশাকে ও নামে দৈশিক ও ধার্মিক ছাপ না থাকে, তাতেও মিলন-ময়দান প্রশস্ত হবে। কুলবাচি পরিহার করলেও অনেকটা ঘুচবে অবাঞ্ছিত ব্যবধান। সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে নির্বিচার বৈবাহিক সম্পর্ক। দেশ-জাত ও বর্ণ-ধর্মের কৃত্রিম বাধা অস্বীকার করে স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণের নির্বিঘ্ন রেওয়াজ চালু হলে অখণ্ড পৃথিবীতে একক জাতি ও অভিন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। কেননা বিবাহের মাধ্যমেই গড়ে উঠে আত্মীয় সমাজ, আর আত্মীয়তা বোধেই মানুষের কোমলতম ও শ্রেষ্ঠতম বৃদ্ধির বিকাশ সম্ভব হয়। …
যে-সব রাষ্ট্রে গোত্রের, বিভিন্ন ধর্মের, একাধিক ভাষার, নানা বর্ণের ও অনেক সম্প্রদায়ের লোকের বাস; সেখানে একক জাতি গঠনে উক্ত সব নীতি-পদ্ধতি অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। এবং কালে ও ক্রমবিকাশে রাষ্ট্র সীমা অতিক্রম করে এই সমমর্মিতা ও সহযোগিতা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হবে। এইভাবেই গড়ে উঠবে পুরোনো নামে ও নতুন তাৎপর্যে মনুষ্যজাতি। তখন একক বিশ্বে মনুষ্যজাতির সামগ্রিক সমস্যার সমাধানের জন্যে সমবেত প্রয়াসে উদ্যোগী হবে প্রতিটি মানুষ। তখন বসতি-বহুল অঞ্চল থেকে মানুষ বসতি-বিরল এলাকায় গিয়ে বাস করতে পারবে, জাত-জন্ম ও বর্ণ-ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কেননা খাদ্য বণ্টনে ও বসতি বিন্যাসে সমতা সাধনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভাবী মানুষের সুখ-শান্তি ও আনন্দ-আরাম। মানুষের প্রাণ-ভ্রমরের নিরাপত্তা অর্জন কেবল এ ব্যবস্থাতেই সম্ভব।
রাজনীতি ও গণমানব
০১.
প্রাচীন ও মধ্যযুগে জাতীয়তার স্থান ছিল না, তখন ছিল প্রবল ও পরাক্রান্ত ব্যক্তির রাজ্য ও সাম্রাজ্য। তখন জোর যার, মুলুক ছিল তার। বসুন্ধরা ছিল বীরভোগ্যা। সে-বীরের জাত-জন্ম ও বর্ণ-ধর্ম বিচারের অধিকার ছিল না কারো।
আদিকালের গোত্র-ভিত্তিক সর্দারতন্ত্রই সংস্কৃতি-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় ক্ষুদ্র ও খণ্ড অঞ্চলভিত্তিক রাজতন্ত্রে এবং আরো পরে সামন্ত সমর্থিত সাম্রাজ্যের বিকাশ লাভ করে। আমাদের পাক-ভারতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঐতিহাসিক স্মৃতির যুগে আমরা দক্ষিণ ভারতে যেমন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর পল্লব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের সন্ধান পাই উত্তর ভারতেও তেমনি ইরানী-আর্য ও মধ্য এশিয়ার শক, হুন, কুশান, তুর্কী, মুঘল সাম্রাজ্যের সংস্থিতি লক্ষ্য করি। সবাই বাহুবলেই ভোগ দখল করেছে দেশের ঐশ্বর্য। জনগণের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক ছিল শাসকের ও শাসিতের, শোষকের ও শোষিতের। এক্ষেত্রে স্বাজাত্য স্বাধৰ্ম ব স্বাদেশিকতা ছিল অনুপস্থিত।
গোত্ৰ-চেতনা অবশ্যই ছিল, ছিল স্বধর্মী প্রীতিও, আরো ছিল স্ব-ভাষীর প্রতি মমতা। কিন্তু সামাজিক স্তর অতিক্রম করে এসব কখনো রাষ্ট্রিক ঐক্য-বোধের কিংবা আর্থিক স্বার্থবোধের উদ্ভব ঘটায়নি। তাই দত্তশক্তি বিদেশী বিজাতি কিংবা বিধর্মী বলেই তারা কখনো বিক্ষুব্ধ হয়নি। যদিও ধর্মমতের ক্ষেত্রে ও সামাজিক স্তরে বিধর্মী ও বিজাতির প্রতি ছিল অসীম ঘৃণা ও অপরিমেয় বিদ্বেষ। কিন্তু স্বার্থ ও অর্থের ক্ষেত্রে কিংবা শাসন ও শোষণের ব্যপারে তারা দেশ-জাত বা বর্ণ-ধর্ম বিচার করেনি। তাই শক-হূন- কৃশানদেরকে এদেশবাসীরা বিদেশী, বিজাতি কিংবা বিধর্মী বলে প্রতিরোধ করতে এগোয়নি। এমনকি হাজারোর্ধ্ব বছর পরেও তুর্কী, মুঘল বা বৃটিশকেও বিদেশী-বিধর্মী বলে কেউ ঠেকানোর বা তাড়ানোর চেষ্টা করেনি। রাজা বদল ছিল প্রজাদের চোখে অনেকটা এ-যুগের জমিদার বদলের মতোই। কোনো অবস্থাতেই তার অধিক কিছু ছিল না। হাত-বদলের সময়ে খাজনাদির ব্যাপারে জনগণের জীবনে আর্থিক বিপর্যয় ও দুর্ভোগ অবশ্যই ঘটত। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। রাজা ছিল শাসক–সেবক নয়। মানুষের উপর তার সর্বাত্মক অধিকার ছিল, তাদের প্রতি দায়িত্ব ছিল না কিছুই। বলতে গেলে একপ্রকারের দায়িত্ব অবশ্যই ছিল, সেটা গৃহস্থের অর্থকর পোষা মেষপাল কিংবা গোধন রক্ষণের ও লালনের দায়িত্বের মতোই। অর্থাৎ রাজস্বের নিশ্চয়তার জন্যে রাজ্যসীমা সুরক্ষিত রাখা ও প্রজাদের শাসনে রাখাই ছিল রাজার দায়িত্ব।
আমাদের এই ধারণার সমর্থনে প্রমাণ অবশ্যই মিলবে। দূর-অতীতের অন্ধকারে না হাতড়িয়ে মধ্যযুগের ভারত থেকেই দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। পর্তুগীজ প্রভৃতি বিদেশী বেনে জাতেরা গোয়া, দামন, দিউ, কারিকল, মাহে দখল করেছিল। এগুলি কোননা-কোনো দেশীয় রাজ্যের এলাকা ছিল। কিন্তু স্বদেশ-চেতনা কিংবা স্বাজাত্য বশে ভারতের কোনো রাজা-বাদশাই তাদের উচ্ছেদ করবার চেষ্টা করেনি। পর্তুগীজ, দিনেমার, ওলন্দাজ, আর্মেনীয়, ইংরেজ ও ফরাসি বেনেদের সহায়তায় প্রতিবেশীকে জব্দ ও পরাজিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল ষোলো শতকের গোড়া থেকেই। কারো মনে এ প্রশ্ন কখনো জাগেনি যে তারা নিজেদের কোন্দলে কোনো বিদেশীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। চোরা কারবারে কিংবা চুরিতে যেমন জাতভেদ নেই, রাজ্য কাড়াকাড়িতেও তেমন জাতধর্মের পার্থক্য চেতনা ছিল না।