ফলে মানুষের বৈষয়িক ও প্রকৌশলিক অগ্রগতির সঙ্গে তাদের মন-মানসের আনুপাতিক সমতা রক্ষিত হয়নি। এ অসামঞ্জস্যজাত অসঙ্গতিই হচ্ছে আজকের দিনের মানবিক সমস্যার উৎস। তাদের জৈব জীবন এগিয়ে চলেছে, মনোজীবন রয়েছে অবিচল। জাগতিক জীবনে তারা বরণ করেছে চলমানতাকেই, মানস-জীবনে কামনা করছে স্থিতিশীলতাকে।
ইতিমধ্যে মানুষে মানুষে পৃথিবী ভরে উঠেছে। ভূ-তে বসতি-বিরল ভুবন নেই আর। বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ায় ও প্রাত্যহিক প্রয়োজন বৃদ্ধির ফলে খণ্ড জগৎ অখণ্ড অঞ্চলে হয়েছে পরিণত। ঘেঁষাঘেঁষির জীবনে রেষারেষি হয়েছে প্রবল। প্রভাবের ও প্রতাপের টানাপড়েন অপরিসর জীবনকে প্রতিমুহূর্তে করছে প্রকম্পিত ও আন্দোলিত। অথচ গোত্রজ সংহতি ও ধর্মজ ঐক্য-ভিত্তিক সমাজ চেতনা আজো জগদ্দল হয়ে চেপে রয়েছে মানুষের বুকে। এ চেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের মন ও মেজাজ। আজকের দিনে যখন অব্যাহত গোত্রীয় স্বাতন্ত্র কিংবা একক ধর্মীয়-সমাজ অসম্ভব, তখন পরকে আপন করে নেয়ার মানস-প্রস্তুতি না থাকলে নির্ঘ নির্বিঘ্ন জীবন কিংবা সমাজ অথবা রাষ্ট্র থাকবে কল্পনাতীত। স্বগোত্রের, স্বধর্মের, স্বমতের ও স্বদেশের নয় বলেই মানুষকে যদি পর ভাবি, শত্রু মনে করি কিংবা অনাত্মীয় করে রাখি; তাহলে আজকের দুনিয়ার মিশ্র সমাজে, এজমালি জমিতে ও বারোয়ারী রাষ্ট্রে কেউ সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে না। পারছে না যে তা কে অস্বীকার করবে? আফ্রিকার গোত্রীয় কোন্দল, য়ুরোপের জাতি-বৈর, আমেকিার বর্ণবিদ্বেষ, ভারতের সাম্প্রদায়িক চেতনা, পৃথিবীব্যাপী পরমত অসহিষ্ণুতা, ধর্মদ্বেষণা ও বিদেশী-বিদ্বেষ আজ মর্তমানবের যন্ত্রণার গোড়ার কথা। এই মৌল সমস্যার সমাধান না হলে স্বস্তি-শান্তির কোনো আপাত প্রলেপে মানব মনের এ দুষ্ট ক্ষতের নিরাময় নেই। এই দেশ-জাত-বর্ণ- ধর্ম চেতনা থেকে মুক্তি-সমাধানের প্রথম ও প্রধান শর্ত। কিন্তু এ মুক্তি সহজসাধ্য নয়। দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টায় অবশ্য সাফল্য সম্ভব। এজন্যে উদার রাষ্ট্রাদর্শ প্রয়োজন।
ধর্ম মানুষ ছাড়বে না। তবু ধর্মবোধের পরিবর্তন সাধন সম্ভব এবং এই লক্ষ্যেই চিন্তাবিদের ও রাষ্ট্রনায়কের প্রয়াস নিয়োজিত হওয়া আবশ্যিক। জনগণকে বলতে হবে–ধর্ম হবে আত্মিক, তা থাকবে ব্যক্তির বুকে এবং মন্দিরে-মসজিদে-চৈত্য-গীর্জায় ও সিনাগোগে। বাইরে বৈষয়িক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে তার উপযোগ কিংবা প্রয়োজন নেই। বলতে হবে-বর্ণ বা অবয়ব হচ্ছে আবহাওয়ার দান, প্রাকৃতিক প্রভাবের প্রসূন। তার জন্যে মানুষে মানুষে প্রভেদ থাকতে পারে না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও হীনতা বিচারের ভিত্তি হবে শিক্ষা-জ্ঞান-প্রজ্ঞা-মনীষা ও চরিত্র। চণ্ডালও হবে দ্বিজশ্রেষ্ঠ যদি থাকে গুণ, জ্ঞান ও চরিত্র। দেশ ভেদে মানুষ শত্রু কিংবা মিত্র হতে পারে না। রুচি ও মনের মিলেই মানুষ হয় আত্মীয়। মানুষে মানুষে প্রীতিই একমাত্র মিলনসূত্র। মনে মনে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেলে বাইরের কোনো বাধাই টিকতে পারে না। স্বামী ও স্ত্রীর মতো আপন কে? দাম্পত্যে কী আমরা ঘরে ঘরে পরকে চিরকাল আপন করে নিচ্ছিনে? দেশ-ধর্ম-জাত বর্ণের বাধাকে অতিক্রম করে কত কত দাম্পত্য গড়ে উঠেছে। এর পরেও কী বলব, অভিন্ন গোত্র বর্ণ-দেশ-ধর্ম না হলে মানুষে মানুষে মিলন সম্ভব নয়? অভিন্ন স্বার্থে সহযোগিতা ও সহাবস্থান যে সম্ভব, তার বহু বহু প্রমাণ কী আমরা অহরহ চারদিকার পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ করছিনে? গোত্র-প্রীতি আর ভূগোল-চেতনাও আসলে একটা সংস্কার। এ সংস্কার দুমুচ্য-দুরপনেয় হলেও, অনপনেয় নয়। আজকের দিনে আফ্রিকাবাসী ছাড়া পৃথিবীর আর কয়জন মানুষই বা স্বগোত্রের খবর জানে? আর কয়জন মানুষই বা স্বদেশের আদি বাসিন্দার বংশধর? যুগে যুগে কত মানুষের ধারা এসে মিশেছে এক এক দেশে। সে-সব মানুষের বংশধরেরা আজ অভিন্ন ধর্মে, ভাষায় ও বর্ণে গড়ে উঠেছে একক জাতিরূপে–হয়েছে অভিন্ন সত্তায় ও আত্মায় বিশ্বাসী। পূর্বপুরুষের মিশ্র ধারার খবরও জানা নেই–অনুভূতি তো দূরের কথা। কাজেই দীর্ঘ সহবাসের ফলে কালে মানুষ একক সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে অভিন্ন সমাজসত্তায় স্বাতন্ত্র্য হারায়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, যাযাবর জীবনেই ছিল মানুষ অভ্যস্ত। মানুষ স্থিতিকামী হয়েছে খোরপোষের দায়ে ঠেকেই। আজো কী আমাদের অন্তরের গভীরে, সে-যাযাবর তৃষ্ণা জেগে নেই?
আসলে দেশ বলে কোনো মাটির মমতা মানুষের নেই, যা আছে তা পরিচিত মনুষ্য পরিবেশের মোহ। অপরিচয়ের অস্বস্তি, আর পরিচিত পরিবেশের প্রশান্তিই রয়েছে দেশ-বিদেশ চেতনার মূলে। এটাকে ভুল করে আমরা মাটির মমতা বলি। স্বগ্রাম-স্বদেশ আসলে মাটি নয়– মানুষ, যে-মানুষ আজন্ম পরিচিত। এজন্যেই প্রবাসে বন্ধু ও পরিচিতের সংখ্যা বেড়ে গেলে মানুষ সেখানেই স্থায়ীভাব বাস করতে চায়। স্বদেশে শহরে বাসের আগ্রহ ও বিদেশকে ভালবাসার প্রেরণা জাগে প্রীতির প্রসারে ও প্রাবল্যে। অতএব, যে-সব সংস্কার বশে আমরা মানুষের প্রতি বিমুখ ও বিরূপ হয়ে থাকি-তার সব কয়টাই কৃত্রিম। পরিহার করা দুঃসাধ্য নয় মোটেই।
স্বার্থ-বুদ্ধির প্ররোচনাতেই আমরা তিলকে তাল করে তুলি, তুচ্ছকে করি উচ্চ, মোহকে ভাবি মমতা, স্বপ্নকে মানি সত্য বলে।