অতএব, অশিক্ষিত লোকের লেখ্য ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই। এবং সব শিক্ষিত লোকেরও ভাষার শুদ্ধাশুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। তাদের বৈষয়িক জীবনে প্রযুক্ত ভাষায় বর্ণাশুদ্ধি কিংবা বাক্যাশুদ্ধি চিন্তায় বা কর্মে কোনো বিপর্যয় ঘটায় না। আর বানান শুদ্ধ হলেই যে ভাষাও বিশুদ্ধ এবং অর্থগ্রাহ্য হবে–তার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। ব্যাকরণ তথা শব্দের অভিধা, আসত্তি ও বাক-রীতি (syntax) আয়ত্তে না থাকলে ভাষা শুদ্ধরূপে বলা বা লেখা চলে না; আর ভাষা শুদ্ধ হলেই যে সুন্দর ও অভিপ্রেতভাব প্রকাশক হয় না, তার জন্যে যে বক্তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, রুচি, ভাব ও প্রকাশ-সামর্থ্য প্রয়োজন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অতএব, বিশুদ্ধ ভাষার প্রয়োজন শিক্ষকের, সাহিত্যিকের, চিন্তাবিদের ও পণ্ডিতের। তারাই নতুন ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে বিদেশী ভাব ও বস্তুর পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে ভাষার অনুশীলন করেন। ভাষা তাদের পেশার ও নেশার অবলম্বন। তাই ভাষা তাদের সর্বক্ষণের সাথী এবং অস্ত্র ও শাস্ত্র। এঁদের জন্যেই ভাষার অবিকৃত রূপ রক্ষা করা প্রয়োজন। যাতে ধাতু ও শব্দমূলের সঙ্গে
তাদের পরিচয় ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থাকে। কেননা প্রকাশের প্রয়োজনে তারা সর্বক্ষণ শব্দ খুঁজে বেড়ান। এবং প্রয়োজনবোধে তারা শব্দ সৃষ্টি করেন। এই সৃষ্টির উপকরণ হচ্ছে ধাতুমূল বা শব্দমূল। ওগুলো জানা না থাকলে নতুন শব্দ সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, পূর্ব বাঙলার সরকার, বাঙলা একাডেমী ও বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড ইংরেজি শব্দের বাঙলা পরিভাষা তৈরির জন্যে তামদুনিক প্রবণতাবশে আরবি ও ফারসির সাহায্য নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বহুনিন্দিত সংস্কৃত ধাতু ও শব্দমূলকেই সম্বল করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক : ক্ষা, ও সা–এ দুটোই ইচ্ছা বাঞ্ছব্যঞ্জক প্রকৃতি। এগুলো দিয়ে আকাঙ্ক্ষা, বুভুক্ষা, মুমুক্ষা, তিতিক্ষা কিংবা বুভুক্ষু, তিতিক্ষু প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থজ্ঞাপক শব্দ তৈরি হয়েছে; তেমনি পিপাসা, জিজ্ঞাসা, জিঘাংসা, উপচিকীর্ষা, অপচিকীর্ষা, লিঙ্গ, বিবমিষা প্রভৃতি শব্দ নির্মাণ সম্ভব হয়ছে। এমনি করে উপসর্গ ও প্রত্যয় যোগে প্রয়োজনমতো অসংখ্য শব্দ রচিত হয়ে ভাষাকে ঋদ্ধ ও সর্বপ্রকার ভাব-চিন্তা-অনুভূতি প্রকাশের যোগ্য করেছে। এভাবেই শব্দগুলো বিভিন্ন তাৎপর্যে সূক্ষ্ম ভাব-প্রতিম ও প্রমূর্ত-অনুভব হয়ে উঠে। মানব-মনীষার বিমূর্ত জগৎ এমনি করে সমূর্ত হয়ে ধরা দেয় সাধারণের কাছে।
জীবন যেহেতু গভীরতর অর্থে অনুভবের সমষ্টিমাত্র এবং যেহেতু সে-অনুভূতি অনুভবযোগ্য হয়ে রূপ পায় ভাষায়, সেহেতু ভাষা জীবানুভূতির নামান্তর মাত্র। মানুষের মানসার্জিত যা-কিছু সম্পদ তা বলতে গেলে এই ভাষারই দান। কাজেই সে-ভাষা নিয়ে আনাড়ির আস্ফালন শুধু-যে ঔদ্ধত্য, তা নয়, মারাত্মকও বটে।
মিলন-ময়দানের সন্ধানে
আদিম অসহায় ও অকুশল মানুষের শিকারে ও শস্য উৎপাদনে যৌথ প্রয়াসের প্রয়োজন ছিল। জ্ঞাতিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল এই যৌথ জীবন। ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্যে রক্ত সম্পর্কে আরোপিত হয় অশেষ নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক গুরুত্ব। তাই জ্ঞাতিত্ববোধই মানুষের প্রথম পবিত্র দায়িত্ব বলে স্বীকৃতি লাভ করে আদিম সমাজে। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অবচেতন গরজে গড়ে উঠা এই বোধ ক্রমে আজন্ম লালিত সংস্কারে ও বিশ্বাসে পরিণতি পায়। এভাবে গভীর প্রত্যয়ে শুরু হয় গোত্রীয় জীবন।
মানব সমাজের শৈশবে-বাল্যে এ গোত্ৰ-চেতনা ও গোত্রীয় জীবন অশেষ কল্যাণ এনেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা সেদিন যৌথ প্রয়াস ছাড়া মানুষের আত্মরক্ষা ও আত্মপোষণ সম্ভব হত না। তারপর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বুদ্ধির ক্রমবিকাশে মানুষ ধর্ম তথা অভিন্ন আচার ও মতাদর্শের ভিত্তিতে রচনা করেছে বৃহত্তর সমাজ। গোত্রীয় চেতনাকে অতিক্রম করে জীবনের সংকীর্ণ পরিসরকে তারা সম্ভাবনার বিস্তৃত প্রান্তরে উন্নীত করল বটে, কিন্তু চেতনার গতি ও প্রকৃতি রইল। অপরিবর্তিত। ফলে স্বাধর্ম ও নবপ্রত্যয়ের প্রাচীর দিয়ে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়িয়ে দিল। আগে। যেমন স্বগোত্রীয় না হলেই শত্রু মনে করা হত, এক্ষেত্রেও স্বমতের না হলেই পর মনে করা স্বাভাবিক হয়ে রইল।
আদিতে মানুষের যৌথ প্রয়াস প্রয়োজনীয় ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে। বিভিন্ন আঞ্চলিক গোত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এখন যৌথ জীবনের প্রয়োজন হল প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের কবল থেকে খাদ্য ও খাক তথা জমি ও জীবন, জল ও জন্তু, প্রাণ ও মাল রক্ষার গরজে।
এই আত্মধ্বংসী গোত্রীয় বিবাদ নিরসনের জন্যেই মতবাদ ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ভাবনায় প্রবর্তনা পায় মানুষ। তার থেকেই আসে ধর্ম নামের জীবন-নীতি। এতে পরিবর্তন মাত্র এটুকু হল। যে ক্ষুদ্র গোত্রীয় দ্বন্দ্ব এখন গোত্র সমষ্টির সমবায়ে গঠিত বৃহৎ সাম্প্রদায়িক হানাহানির রূপ নিল। অতএব চারিদ্র্যে ও আদর্শে কোনো রূপান্তর কিংবা উন্নয়ন ঘটেনি।
অভিজ্ঞতা, প্রকৌশল, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে নব উদ্ভূত মানবিক সমস্যার সমাধানের জন্যে যে আনুপাতিক চিন্তা-ভাবনা, পরিহার-সামর্থ্য, গ্রহণশীলতা ও সৃজনপ্রবণতা থাকা আবশ্যিক ছিল; অদূরদর্শী মানুষে তা কখনো সুলভ ছিল না। জ্ঞানী-মনীষীরা স্বকালের সমস্যার আপাত সমাধান পেয়েই চিরকালের মানুষের জন্যে প্রশস্ত জীবন-পথ রচনার গৌরব-গর্ব ও সাফল্য-সুখ অর্জন করতে চেয়েছেন। তারা নিজেদের মতাদর্শকে চরম ও পরম বলে জেনেছেন এবং জনগণকেও সে-ধারণা দিয়ে বিভ্রান্ত ও বিমূঢ় করে রেখেছেন। এভাবে তাঁদের। অজ্ঞাতেই তারা মানুষের মন করেছেন আনুগত্যের দীক্ষায় নিষ্ক্রিয় এবং মননক্ষেত্র করেছেন অসীম ভরসা দানে বন্ধ্যা।– বৈষয়িক ও জাগতিক আর সব ব্যাপারে মানুষ জানে অতীতের চেয়ে বর্তমান অনেক উন্নত। হোমারের চাইতে শেক্সপীয়ার, ভিঞ্চির চাইতে পিকাসো, সেন্ট অগাস্টাইনের চাইতে টয়নবী, জুলিয়াস সিজারের চাইতে জর্জ ওয়াশিংটন, ইডিপাস থেকে ফাউস্ট যে অনেক অগ্রসর তা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু আদ্যিকালের শাস্ত্রের চাইতে উন্নত নিয়ম-নীতি কোথাও কখনো আর কিছু যে হতে পারে, তারা বরং প্রাণ দেবে, তবু তা স্বীকার করবে না। এখানে তারা প্রত্যয়-সর্বস্ব, অন্ধ ও গোঁড়া। বৈষয়িক ব্যাপারে তারা শ্রেয়সকে সহজেই গ্রহণ করে, নতুন স্বাচ্ছন্দ্যকে বরণ করবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে; কিন্তু মতের ক্ষেত্রে, মননের জগতে, পুরোনোই তাদের প্রিয়, প্রাচীনত্বেই তারা পরিতৃপ্ত, বিশ্বাসেই তাদের ভরসা।