১. তাঁরা বলেন, শব্দের বানান উচ্চারণ অনুযায়ী হওয়া উচিত। প্রশ্ন জাগে, পূর্ব বাঙলার কোনো দুটো অঞ্চলের উচ্চারণ এরকরম নয়। ভাষাবিজ্ঞান বলে–কোনো দুটো মানুষই অবিকল একরকম উচ্চারণ করতে পারে না। এমনকি কোনো মানুষের পক্ষেই কোনো শব্দ একই রূপে দুবার উচ্চারণ করাও সম্ভব নয়। তাহলে তারা কোন অঞ্চলের কোন্ ব্যক্তির উচ্চারণ অনুযায়ী বানান-পদ্ধতি নির্মাণ করবেন? তাছাড়া, যেহেতু উচ্চারণ জনে-জনে, স্থানে স্থানে ও কালে কালে বদলায়, সেহেতু উচ্চারণের অনুগত করে বানান সংস্কার করতে হলে প্রায় প্রতিজনের জন্যে ও প্রতিস্থানে এবং প্রতি পঞ্চাশ বছরে বর্ণ ও বানান বদলাতে হবে। তাহলেই কেবল বিজ্ঞান সম্মত সংস্কার সম্ভব। দুনিয়ার কোথাও কখনো শব্দের বানান উচ্চারণ-অনুগ হয় না।
উপরোক্ত কারণে হতে পারে না বলেই হয় না। লেখ্য ভাষার মাধ্যমেই এক দেশের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও ঐতিহ্যিক জ্ঞাতিত্ব রক্ষা করে। কেননা আঞ্চলিক বুলি প্রতিমুহূর্তে রূপান্তর লাভ করছে ও দেশের মানুষকে পারস্পরিক আত্মীয়তা ঘুচিয়ে স্বাতন্ত্র্য দান করছে। সেই লেখ্য ভাষার জোর নিহিত থাকে তার দীর্ঘকালীন অপরিবর্তনীয়তায়। অতএব, লেখ্য ভাষা মাত্রেই কৃত্রিম। কাজেই সাধারণ অর্থে মাতৃভাষা বলতে যা বুঝায়, আসলে এ তা নয়। বুলির মতো এ শৈশবে লভ্য নয়। একজন বিদ্বান বলেছেন, মাতৃভূমি মানে যেমন মামার বাড়ি নয়, মাতৃভাষাও তেমনি মায়ের মুখের বুলি নয়। অন্যান্য বিদ্যার মতো লেখ্য ভাষাও একটি বিদ্যা এবং তা অনায়াসলভ্য নয়। অন্যান্য শাস্ত্রের মতো ভাষাও পরিশ্রম করে আয়ত্ত করতে হয়।
২. তাঁদের আর একটি যুক্তি–কিছু বর্ণ বর্জন করে বানান সংস্কার করলে, শিক্ষার্থীর পক্ষে ভাষা শেখা সহজ হবে। কিন্তু তাতেই কী বানান ভুলের খপ্পর থেকে বাঁচা যাবে? বাধাকে-বাঁধা, চোরকে–চুর, বিধাতাকে–বিদাতা, বাড়িকে–বারি, ঘনিষ্ঠকে–ঘনিষ্ট, সম্বন্ধকে সম্মন্দ লেখার বিড়ম্বনা থেকে শিক্ষার্থীরা উদ্ধার পাবে কী করে? আসল কথা: শিখবার, জানবার, বুঝবার যোগ্যতা ও আগ্রহ যাদের থাকে তারাই কেবল ভাষা সমেত যে-কোনো বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারে।
কেউ কেউ বলেন Type, Telegraph ও stenography-র জন্য বর্ণসংখ্যা কমানো দরকার। যন্ত্র তো আমাদের প্রয়োজনেই তৈরি। যন্ত্রকে আমরা আমাদের অনুগত করে নেব, আমরা কেন যন্ত্রের অনুগত হব? আরবি-উর্দু হরফের রয়েছে শব্দের আদ্যে-মধ্যে-অন্ত্যে তিনটি ভিন্ন রূপ। ইংরেজিরও Capital ও small letter যেমন রয়েছে, তেমনি হস্তাক্ষর পায় একেবারে ভিন্ন। অবয়ব। তাছাড়া ইংরেজির কয়েকটি বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি বিভিন্ন উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়। যেমন, C ক, চ, Th—ত,দ, ghফ,উহ্য,ch–চ, ক, ou-আ, E–আ, এ, ই, a–এ্যা, আ, ই, আই, ইত্যাদি। এছাড়াও বর্ণের উচ্চারণ উহ্য তো থাকেই। কোনো ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ বানান অনুগ নয়। তবু আমরাই এ বিদেশী ভাষার প্রত্যেকটি বানান নির্ভুলভাবে আয়ত্ত করেছি! বাঙলা বর্ণমালা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাজানো, প্রত্যেকটা বর্ণ উচ্চারণসাধ্য। কেবল জ+ঞ=জ্ঞ ব্যতীত আর কোথাও বানানে ও উচ্চারণে অসঙ্গতি নেই। আধুনিক মুদ্রণালয়ে যুক্তবর্ণের অবয়ব সংস্কারের ফলে ব্যঞ্জন বর্ণগুলো প্রায় সর্বত্রই অবিকৃত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেবল স্বরবর্ণের কার ও কয়েকটি ব্যঞ্জনবর্ণের ফলা-ই যা ব্যতিক্রম।
৩. তাঁদের কাছে, ত-২, ই-ঈ, উ-ঊ, ঋ-র, ন-ণ, জ-য, খ-ক্ষ, ঙ-ং, ব-ভ মহাসমস্যার বিষয়। অথচ সব ভাষাতেই এমনি আপাত ঐক্যের পৃথক বর্ণ রয়েছে। ইংরেজিতে g-j-z, c-k, a-u-e, j-s, F-gh, x-ks, ct, cz ইত্যাদি এবং আরবিতে রয়েছে জিম-জাল-ডাল-জে-জোয়াই, কাফ কোয়াফ, হে-হামজা, আলিফ-আইন ইত্যাদি। তাছাড়া কৃত্রিম স্বর-চিহ্ন যুক্ত না হলে যে-কোনো স্বর যোগে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের শুদ্ধ-প্রতিম বিকৃত উচ্চারণ সম্ভব।
৪. পাকিস্তানে সম্প্রতি চারটি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক। শাস্ত্রীয় ভাষা আরবি, সরকারি ভাষা ইংরেজি এবং রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাঙলা। কেবল বাঙলা বানান সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না, করতে হলে উক্ত চারটি ভাষারই উচ্চারণ-অনুগ বানান সংস্কার করতে হবে। তাহলেই আমাদের মহৎ জাতীয় উদ্দেশ্য সফল ও সার্থক হবে। অর্থাৎ উক্ত চার ভাষারই একটি করে পাকিস্তানীরূপ রচনা করতে হবে। তা কেবল পাকিস্তানীর হিতার্থে পাকিস্তানেই চলবে। যদি বিদেশী ভাষা বলে ইংরেজি, আরবি, উর্দু ভাষা সংস্কারে আমাদের অধিকার না থাকে, তাহলে বাঙলাতেও কী সে অধিকার থাকে? কেননা, পাকিস্তানের বাইরেও বাঙলা ভাষার মালিক আছে। অতএব, অপর তিনটে ভাষাই যখন যথাপূর্ব সকল জটিলতা ও অসঙ্গতি নিয়ে আমাদের শিক্ষার অঙ্গীভূত রয়েছে, তখন বেচারা বাঙলাকেও দয়া করতে বাধা কি?
৫. তাছাড়া, লেখ্য ভাষার প্রয়োজন কেবল শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত লোকেরই। শিক্ষার্থীর শিক্ষা কেবল ভাষার উপর নির্ভর করে না। জটিলতর বিষয় ও বিদ্যা তাকে অর্জন করতে হয়। ভাষা বুঝলেই অঙ্ক কষা যায় না; কিংবা ইতিহাসে দর্শনে জ্ঞান অর্জিত হয় না। কিংবা দ্বিতীয় পাঠের . সুবোধ বালকের গল্পের ঋজু ভাষা দিয়ে দর্শন বা মনোবিজ্ঞান শেখা চলে না। অতএব ভাষার সারল্য ও জটিলতা বিষয়ানুসারী। যে বয়সে শিশু বর্ণশিক্ষা করে সে-বয়সে তার ধীশক্তি বিকশিত থাকে না। কাজেই তার শিক্ষা অনেকটা চোখ-কান নির্ভর ও স্মৃতিভিত্তিক। এজন্যে তার কাছে সরল জটিলের পার্থক্য সামান্য। তাই তাই তাই মামার বাড়ি যাই যেমন যুক্তাক্ষর বর্জিত, যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই-ও তেমনি। তাই বলে কী যে-কোনো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন লোকই কী শেষোক্ত চরণের তাৎপর্য বুঝবে? তার জন্যে বয়স ও বিদ্যার প্রয়োজন হয় না কি?