আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু নাম সাধারণ্যে চালু হতে থাকলেও উনিশ শতকের আগে এ নাম সর্বজনগ্রাহ্য বা তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। আঠারো শতকেও উর্দু গদ্য হিন্দি নামে এবং উর্দু কবিতা রিখতা নামে পরিচিত ছিল। স্যার সৈয়দ আহমদের পত্ৰসূত্রে জানতে পাই উনিশ শতকের শেষার্ধেও দিল্লী থেকে বিহার অবধি অঞ্চলের ভাষার নাম ও হরফ নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছিল। হিন্দুরা ছিল হিন্দি-নামের ও নাগরী হরফের পক্ষপাতী আর মুসলমানেরা ছিল উর্দু নামের ও ফারসি হরফের অনুরক্ত। আরো দুটো তথ্য স্মর্তব্য : ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন গিলাইস্টের প্রবর্তনাতেই উর্দুভাষা স্বাতন্ত্র্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছে এবং এ ভাষা মুসলিম রাজশক্তির ও সংস্কৃতির পতন যুগেই বিকাশ লাভ করে। অতএব, এটি উজ্জীবিতের নয়, নির্জিতের ভাষা ও সাহিত্য। এ কারণেই সম্ভবত প্রখ্যাত মুসলিম কবিদের শ্রেষ্ঠ রচনার বাহন হয়েছে ফারসি-উর্দু নয়।
৩. এদের আর একটি যুক্তি : উর্দুভাষা ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য ও তমদুনের আকর।
ভাষার গুণেই কী ধর্মীয় শাস্ত্র, সাহিত্য ও তমদুন গড়ে উঠে? ধর্মভাব থাকে মনে, তা-ই প্রকাশিত হয় ভাষায় ও আচরণে। মুসলমানের অভিপ্রায় ও প্রচেষ্টাতেই আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় ইসলামী শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছে। অমুসলমানের আগ্রহে যেমন ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় রচিত হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস সম্পর্কিত নানা গ্রন্থ। বাঙলায় যে শাস্ত্রগ্রন্থ নেই–এ-তথ্যই বা তারা সংগ্রহ করল কিরূপে? আর যদি না-ই থাকে, তাহলে প্রয়োজনবোধে বাঙলায় ইসলামী শাস্ত্র, সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন গ্রন্থ রচনা করতে ভাষাগত কিংবা স্থানগত বাধা আছে কি?
মানুষের মনের যে ভাব-ভাবনা জেগে উঠে, তা-ই তার ভাষায় লিখিত বা রচিত রূপে প্রকাশ পায়। বাঙালি যদি ইসলাম চর্চায় মনোযোগী হয়, সে প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে অন্যান্য বিষয়ে যেমন সে গ্রন্থ রচনায় সমর্থ, এ বিষয়েও সে কাজ করবে, বই লিখবে, বাইরের লোকের এ ব্যাপারে মুরুব্বিয়ানা অহেতুক। কেননা বাঙালি মুসলমানরা হাজার বছরের পুরোনো মুসলমানের বংশধর। ইসলামের কী তার অজানা রয়েছে যে, সে রাজনৈতিক কারণে নতুন পীরের মুরিদ হবে? তাছাড়া নিছক ধর্মীয় কোনো তমদুন থাকতে পারে না। তাই যদি হত, তাহলে ভূগোল ও কাল নিরপেক্ষ একটি নিবর্ণ ও চিরন্তন বিশ্বমুসলিম সংস্কৃতি থাকত। দেশান্তরে ও কালান্তরে তা রূপান্তর লাভ করত না। বস্তুত দেশ-কাল-ব্যক্তি নিরপেক্ষ এবং শৈক্ষিক, আর্থিক, সামাজিক ও নৈতিক প্রতিবেশবিরহী কোনো সংস্কৃতি কল্পানাতীত। সংস্কৃতি তাই স্বরূপত ব্যক্তিক ও অবস্থানিক বা পারিবেশিক। ইসলামে অনুরাগই যদি উর্দুপ্রীতির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আরবিকেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। স্মর্তব্য যে আরবি-ফারসি কিংবা উর্দুর সবটা শাস্ত্রীয়ও নয়, সু-মুসলমানের রচনাও নয়। আজো উক্ত তিন ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সব মুসলিম নন। আজো আরবিভাষী লোকের শতকরা পনেরো জন খ্রীস্টান ও ইহুদী। উর্দুও কেবল মুসলমানের দানে ঋদ্ধ হয়নি। কাজেই আরবি-ফারসি শব্দ ও সাহিত্য মাত্রই ইসলামী নয়, একাধারে অমুসলিমেরও। অতএব বাঙলা ভাষার নিন্দা-কলঙ্ক রটানোর মূলে অভিসন্ধিই ক্রিয়াশীল। ন্যায়ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাঙলাই হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বেরাদরীভাবে বিগলিত আত্ম-প্রত্যয়হীন হীনমন্য ও প্রভুগত প্রাণ বাঙালিরা সে-কথা ভাবতেও সাহস পায়নি। ফলে উত্তরভারতের ভাষা আপাতত আসন জুড়ে বসেছে পাকিস্তানে। এ অন্যায়েরও জবর-দখলের পক্ষে নৈতিক সমর্থন সঞ্চয়ের জন্যেই এত ছল-চাতুরীর আশ্রয় ও প্রশ্রয় জরুরি হয়েছে।
বলেছি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে উর্দুকে অস্বীকার করবার মতো ভাষার ঐশ্বর্য ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানীদের। আজ তারাও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের অনলস সাধনায় তারা স্ব স্ব ভাষাকে অনেকখানি উন্নত করেছে। কাজেই আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কথা বলবার মতো নৈতিক ভিত্তিও রচিত হয়েছে তাদের। এর মধ্যেই সিন্ধি, সারাইকী, পশতু ও বেলুচ ভাষীরা ভাষার ক্ষেত্রে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তারা আত্মসম্মানবোধে ও পরিণাম চিন্তায় বিচলিত। তাই তারা আজ প্রবুদ্ধ ও উচ্চকণ্ঠ। আজ যখন পাকিস্তান প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস ও উল্লাস অপগত, আর স্ব-ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সচেতন এবং উর্দুও যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আজো স্বপ্রতিষ্ঠিত নয়, তখন পাকিস্তানে উর্দুর ভবিষ্যৎ নতুন করে যাচাই করার সময় এসেছে। রাষ্ট্রভাষা হিন্দির বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যে যেমন, উর্দুর বিরুদ্ধেও তেমনি প্রতিবাদী দল অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠবে–সে আশঙ্কা অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই তার আভাস সুপ্রকট। পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বতন প্রদেশগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা এ আশঙ্কাকে প্রবল করছে। কেননা, প্রদেশগুলোর সংস্থিতি ভাষা-ভিত্তিক।
.
০৫.
বাঙলা ভাষার সংস্কার-প্ৰয়াস সরকারি-উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানে তখন অনেক সমস্যা ছিল। বাঙলা ভাষার হরফ ও বানান কোনো সমস্যা ছিল না, তবু অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বাঙলা ভাষা সম্পর্কিত একটি কাল্পনিক সমস্যার সমাধান সরকারি অফিসে অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছিল। তারই ফলে ভাষা-সংস্কার কমিটিগুলো পর পর গড়ে উঠে–সরকারি কমিটি, বাঙলা একাডেমী কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ও ব্যক্তিগত প্রয়াস চারদিক মাতিয়ে তোলে। ঐদিকে আরবি হরফে বাঙলা লেখানোর অভিযানও সরকারি অর্থে চলতে থাকে। প্রয়াসটা যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক তা বুঝতে কারো বাকি থাকল না। উক্ত সব কমিটির সদস্যদের সবাই ভাষাবিদও ছিলেন না। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও ক্ষোভজনক আনাড়ির অনধিকার চর্চার আগ্রহ। অতএব কলকাঠি ঘুরাচ্ছিল যারা, তারা ছিল নেপথ্যে; পুতুল ও যন্ত্ররূপে যাদের সুমুখে দেখেছি, তাঁরা আমাদের ঘরের লোক–অনেকেই শ্রদ্ধেয়। তাই জনমনে প্রভাব পড়েছিল তাদের। এই কপট হিতৈষীরা তাই আজো নির্বিঘ্নে ভাষা সংস্কার রূপ মহাসমস্যা নিয়ে উদ্ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন। মাঝে মাঝে তারা দুঃস্বপ্নের মতো জেগে উঠেন। আতঙ্কিত করেন আমাদের। এর পশ্চাতে মূল উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষাকে বাঙালির মতানৈক্যের সুযোগে রাষ্ট্রভাষার অধিকারচ্যুত করা। আর আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য রোমান হরফ বা আরবি হরফ চালু করে এর বিকৃতি সাধন করে বিকাশ-পথ রুদ্ধ করা এবং তৎসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাঙলা ভাষার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।