.
০৪.
বাঙালি-মনে জড়তা ও জীর্ণতা দানের গোপন উদ্দেশ্যে তারা যেসব পন্থা উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় জীবন বিকাশে সেসবের উপযোগ ও ফলপ্রসূতা প্রমাণের জন্যে তারা সাধারণত যেসব যুক্তি উপস্থাপিত করে, আমাদের মন্তব্য-সমেত সেগুলো এখানে তুলে ধরছি :
১. তারা বলে বাঙলা আরবি-ফারসি শব্দ-বহুল ছিল। উনিশ শতকে পাদরী ও পণ্ডিতের ষড়যন্ত্রে বাঙলা সংস্কৃতি-ঘেঁষা হয়ে উঠেছে। এর মূলে কোনো সত্য নেই। পনেরো শতকের শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি চুহর অবধি কবির লিখিত রচনায় এবং গোপীচাঁদ-ময়নামতীর গান, পূর্ববঙ্গ-ময়মনসিংহগীতিকা, বাউলগান থেকে অল্পশিক্ষিত আজকের কবির মৌখিক রচনা অবধি কোথাও আরবি-ফরাসি শব্দবহুল বাঙলার নমুনা মেলে না।
হাওড়া-হুগলী-কোলকাতা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল ছিল আন্তর্জাতিক ও আন্তরাঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র। য়ুরোপীয়রা ছাড়াও ভারতের, ইরানের ও মধ্য-এশিয়ার লোক এখানে বাস করত। ফারসি ও হিন্দি ছিল Lingua Franca ভাব বিনিময়ের ভাষা। স্থানীয় বাঙলার সঙ্গে ফারসি-হিন্দির মিশ্রণে গড়ে উঠে খিচুড়ি বাঙলা। এর উদ্ভব ও প্রকৃতি অবিকল দাখিনী উর্দু ও উত্তর ভারতীয় উর্দুর মতোই। এটি ছিল বন্দর এলাকার সঙ্কর বাঙালির বুলি। উক্ত অঞ্চলের বাইরে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সত্যপীর পাঁচালী প্রণেতা এই অঞ্চলের হিন্দু কবিরা সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর বংশোদ্ভব বলে কথিত সত্যপীরের মুখে বিকৃত হিন্দুস্থানী বুলি প্রয়োগ শুরু করেন সতেরো শতক থেকেই। এঁদের অনুকরণে ১৭৬০ সনের পরেরকার কবি হুগলী বন্দরের শায়ের ফকির গরীবুল্লাহ বাঙলা ও হিন্দুস্থানী বাক্রীতির মিশ্রণে কাব্যরচনা করেন। তাকে অনুসরণ করেন হাওড়াবাসী কবি সৈয়দ হামজা। উনিশ ও বিশ শতকে এ অঞ্চলের মালে মুহম্মদ, জনাব আলী, রেজাউল্লাহ, মুহম্মদ খাতের, মুহম্মদ দানিশ, আবদুল মজিদ প্রভৃতি প্রায় শত পেশাদার শায়ের উক্ত মিশ্ররীতি প্রয়োগে অনুবাদমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
উনিশ শতকের শেষার্ধে মীর মশাররফ হোসেন, রিয়াজ আল দীন, মাশহাদী প্রমুখ মুসলিম লিখিয়েরা এর নাম দেন দোভাষী রীতি। বিশ শতকে হিন্দুরা এর নাম রাখেন মুসলমানী বাঙলা। আর ১৯৪০ সনের পরে মুসলমানরা এ সাহিত্যের নাম দেন পুথি-সাহিত্য। কোলকাতার ছাপাখানার বদৌলতে এগুলো সারা বাঙলা দেশে প্রচার লাভ করে। বিকল্প পাঠ্যগ্রন্থের অভাবে গ্রাম-বাঙলার স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুসলমান শোধ্ব বছর ধরে এগুলো পড়েছে–শুনেছে বটে, কিন্তু এর বাীতি বা ভাষার দ্বারা কোথাও কেউ কখনো প্রভাবিত হয়নি। প্রমাণ পুথিসাহিত্য পড়য়া গ্রাম্য বাঙালির রচিত গান-গাথা, কবিতা এবং কথাবার্তা।
পূর্বোক্ত অঞ্চলে ছাড়া অন্যত্র বাঙলা ভাষায় যে আরবি-ফারসি শব্দ বিরল ছিল, তা কেবল হালহেড় বা ফরস্টারের উক্তি থেকেই নয়, কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ কিংবা ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সম্বাদ-এর ভাষা থেকেও প্রমাণিত। উক্ত বন্দর ও শাসন-কেন্দ্রের সঙ্কর বাঙালিরা ছাড়াও দরবারীভাষা ফারসি শিক্ষিত অসাহিত্যিক বাঙালিরা কথাবার্তায় ও বৈষয়িক চিঠিপত্রে, দলিল দস্তাবেজে দেদার ফারসি শব্দ ব্যবহার করত, এখনকার অসাহিত্যিক রচনায় কিংবা কথাবাতায় ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা যেমন অজস্র ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে। তাই বলে গ্রাম-বাঙলার অশিক্ষিত মানুষকে পূর্বে ফারসি এবং এ যুগে ইংরেজি ভাষা প্রভাবিত করেছে বললে সত্যের অপলাপই হয়। প্রমাণস্বরূপ বলা চলে বাঙলার পল্লী অঞ্চলের মুসলমান নারী-পুরুষদের যারা পুরুষানুক্রমে চিরকাল নিরক্ষর, তাদের উপর নিশ্চয়ই উনিশ শতকের পাদরী ও পণ্ডিতের কিংবা এ যুগের পুস্তকী ভাষার প্রভাব পড়ার উপায় ছিল না বা নেই। তবে তাদের আঞ্চলিক বুলিতে শাস্ত্রীয় কিংবা সরকার সম্বন্ধীয় পরিভাষা ব্যতীত অন্য আরবি-ফারসি-হিন্দির প্রভাব নেই কেন!
২. তারা আরবি-ফারসি শব্দের মধ্যেই ইসলাম ও তমদুনের স্থিতি প্রত্যক্ষ করে। অথচ এ দুটোই ইসলাম-পূর্ব যুগের পৌত্তলিক-বেদীনের ভাষা। তবু আল্লাহ ও ইলাহী শব্দদুটোকে নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করতে অসুবিধে হয়নি। সাকার সকন্যা দেবতা মুহূর্তে নিরবয়ব স্রষ্টার ভাবরূপ লাভ করেছেন মুসলিম মনে, এমনকি ইসলামী অঙ্গীকারের মৌল শব্দগুলো–আল্লাহ, রসুল, মক, জান্নাত, জাহান্নাম, সালাত, সিয়াম প্রভৃতি ইরানে খোদা, পয়গম্বর, ফেরেস্তা, বেহেস্ত, দোজখ, নামায, রোযা রূপে অনূদিত ও গৃহীত হয়েছে। পাক-ভারতে ইরানী পরিভাষাই গৃহীত হয়েছে, তৎসঙ্গে খোদার দেশী পরিভাষাও যুক্ত হয়েছিল : নিরঞ্জন, নাথ, ধর্ম, করতার এবং বেহেস্ত দোজখও হয়েছিল স্বর্গ ও নরক।
উল্লেখ্য যে একটি আরবি শব্দও সরাসরি পাক-ভারতের ভাষায় গৃহীত হয়নি। সব কয়টিই এসেছে ফারসির মাধ্যমে। আর উর্দু বলে কোনো ভাষা ছিল না বা নেই। বৈদিক ভাষার উত্তরভারতীয় আঞ্চলিক বুলিতে ফারসি শব্দের আধিক্যে ও ফারসি হরফ প্রযুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে আধুনিক উর্দু। উর্দু নামটাই অর্বাচীন। এটি একটি মঙ্গোলীয় শব্দ, অর্থ সৈন্য-শিবির। সামরিক বাহিনীর তথা সৈন্য-শিবিরের Lingua Franca অর্থে চালু হল এটি।
বিদেশাগত শাসক-প্রশাসক ও তাদের অনুচরেরা প্রয়োজনানুরূপ দেশী শব্দ আয়ত্ত করার অসামর্থবশে উত্তরভারতীয় ভাষায় তুর্কী-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগে ভাব প্রকাশ করত এবং দেশী হরফ শিক্ষার ঝামেলা এড়িয়ে ফারসি হরফে পরবর্তীকালে লেখাও শুরু করল। এভাবে ফারসি শব্দবহুল এবং ফারসি হরফে লিখিত একটি ভাষা দাঁড়িয়ে গেল। তবু জাতি বিচারে উর্দু একটি আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষা। কেননা শব্দ দিয়ে ভাষার জাতি নির্মিত হয় না, হয় বাক্য-গঠন রীতি বা ব্যাকরণ দিয়ে। তাছাড়া শব্দের দিক দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাই–সভ্যজাতির ভাষা মাত্রই মিশ্র। অবশ্য ফারসিও যে বৈদিকি ভাষার জ্ঞাতি-পহ্লবী ভাষার আধুনিক রূপ, তাও এ সূত্রে স্মর্তব্য। প্রমাণস্বরূপ বলা চলে ষোলো শতকের উত্তরভারতীয় কবি কুতবন, মালিক মুহম্মদ জায়সী, মিয়া সাধন, এয়ারী, কবীর, দাদু, রজব, দরিয়া প্রমুখ সবাই আঞ্চলিক হিন্দিতে নাগরী হরফেই কাব্য রচনা করেছেন, তখনো ঐ রিখতার ভাষা ছিল হিন্দবী (আমীর খুসরু) দাখানী (দাক্ষিণাত্যে) দেহলবী (আবুল ফজল), হিন্দি বা গুজারী বা গুজরাটী (গুজরাটে)। শিবিরের ভাষা হিসেবে উর্দু নাম সতেরো শতকের শেষের দিকে সৈন্য-সমাজে হয়তো চালু হয়েছিল।