উর্দুভাষী শাসক-প্রশাসকেরা যখন কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের সুযোগে তাদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে কৃতসংকল্প, তখন প্রায়-বুলি-নির্ভর পশ্চিম পাকিস্তানীদের আপত্তির কোনো কারণ ঘটেনি। তাছাড়া নতুন রাষ্ট্রপ্রাপ্তির উল্লাস এবং বিজাতি বিদ্বেষজাত ইসলামী বেরাদরী ভাবটাও ছিল তখন জনমনে প্রবল। পূর্ব-বাঙলার একশ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরও ছিল এই বেরাদরী উদারতা ও হিন্দুভীতি। তারাও হিন্দুস্তানী ও পাঞ্জাবী বেরাদরের প্রতি সর্বব্যাপারে ছিল শ্রদ্ধাবান ও নির্ভরশীল। তার উপর, জিন্নাহর কায়েদে আযম নামের ফাঁকে একটা personality cult বা ব্যক্তিপূজার প্রবণতা জনসমাজে গভীর ও ব্যাপক রূপ নিয়েছিল। উর্দুভাষী অনুচরদের প্রভাবে গুজরাটী-ভাষী জিন্নাহও উর্দুর পক্ষে রায় দিলেন। কাজেই অনুগ্রহজীবী বাঙালি নেতারাও এদের কেউ কেউ ছিলেন উর্দুভাষী] জুটে গেলেন উর্দুর দলে। বাকি রইল বাঙলার ছাত্র, সাহিত্যিক ও তরুণ বুদ্ধিজীবীরা। ছাত্রদের সক্রিয় সংগ্রামে অবশেষে বাঙলা মৌখিক স্বীকৃতি পেল, কিন্তু অকপট অন্তরে গৃহীত হল না অবাঙালি সমাজে। তার গূঢ় কারণ ছিল।
.
০২.
মাতৃভাষার প্রতি নিছক প্রীতিবশেই তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়নি, চেয়েছিল সাম্রাজ্যিক স্বার্থলোভে। কেননা তারা জানত স্বাধর্মের নামে বিধর্মী-বিদ্বেষ জাগিয়ে সাময়িক সাফল্য অর্জন সম্ভব হলেও বৈষয়িক ব্যাপারে এ কখনো স্থায়ী প্রেরণার আকর হতে পারে না। কাজেই বিধর্মী বিদ্বেষপুষ্ট ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উত্তেজনা দুই বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সাময়িক সংহতি দান করলেও তা নিতান্ত নশ্বর। অতএব পরিণাম ভেবেই তারা সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্যিক নীতি গ্রহণ করে শোষণের স্থায়ী ব্যবস্থা রাখার উদ্দেশ্যেই। ইতিহাস বলে এবং সবাই জানে, কেবল বাহুবলে শাসন শোষণ কায়েম রাখা চলে না। শাসিত জনকে অনুরক্ত করেই আনুগত্য আদায় করতে হয়। এর পরীক্ষিত ও অমোঘ ফলপ্রসূ উত্তম উপায় হচ্ছে, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে শাসিত জনের মনে-মেজাজে একপ্রকার মুগ্ধতার কুয়াশা রচনা করা। শাসকজাতির ভাষার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শন ও ইতিহাস শাসিত জনের মনে মাকড়সার জাল তৈরি করে, তার ফলে শাসকগোষ্ঠীর প্রতি শাসিতজন শ্রদ্ধাবান ও সহিষ্ণু হয়ে উঠে। ধনের, মানের ও মর্যাদার ক্ষেত্রে শাসিতজনের হীনমন্যতা এবং শাসকগোষ্ঠীর উত্তমন্যতাও এ ক্ষেত্রে আনুকূল্য করে। চিরকাল এমনি উদ্দেশ্যে বিদেশী শাসকরা শাসিতজনের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে বা তার বিকাশ রুদ্ধ করে নিজেদের ভাষা ও বর্ণমালা চালু করেছে। এর ফলে শাসিতজনের বুদ্ধি হয় আড়ষ্ট, চিন্তাশক্তি পায় হ্রাস, দৃষ্টি হয় আচ্ছন্ন, মন থাকে অনুরক্ত। এমনি অবস্থায় আনুগত্যের স্বস্তিই হয় প্রজার কাম্য। প্রতীচ্যবিদ্যার ও সংস্কৃতির প্রভাবে এদেশের শিক্ষিত সাধারণেও ব্রিটিশ-প্রীতি এমনি গাঢ় হয়ে উঠেছিল বলেই সিপাহী-বিপ্লব কালে তা যে শুধু নিষ্ক্রিয় ছিল তা নয়, ইংরেজদের বিপর্যয়ে উদ্বিগ্নও হয়েছিল এবং ব্রিটিশ-বিজয়ে তাদের উল্লাসের সীমা ছিল না। অতএব শাসিত-মনে জরা ও জীর্ণতা দানের মোক্ষম উপায় হচ্ছে তাদের ভাষা কেড়ে নেয়া এবং শাসকগোষ্ঠীর ভাষা চালু করা।
.
০৩.
গোড়া থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা অবচেতনভাবেই উপলব্ধি করেছিল পূর্ব বাঙলা হবে তাদের খাজনা উসুলের জমিদারী এবং শুল্ক আদায়ের বন্দর–একটি অনায়াসলব্ধ উপনিবেশ। ভেততা ও ভীতু বাঙালি নেতাদের প্রাণী বিশেষের মতো আনুগত্য তাদের লোভ ও ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা লক্ষ্য করেছিল, বাঙালিরা তখন বেরাদরীভাবে বিগলিত। সামরিক ও বেসামরিক চাকরির ব্যাপারে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিংবা আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্পে তাদের ন্যায্য দাবি উত্থাপনে তারা পরম উদারতায় উদাসীন। এই ঔদাসীন্য যেন চিরস্থায়ী হয়, তার জন্যে তারা নানা ছলাকলা উদ্ভাবনে সদাতৎপর। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ইসলাম। দেশে অমুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তবু বাঙালির স্থায়ী আনুগত্য লাভের দুরাশা বশে তারা বাঙালির মনে ইসলামী উত্তেজনা জাগিয়ে রেখে, তাদের মনে বিধর্মী-বিদ্বেষকে তথা হিন্দু-ফোবিয়ায় স্থায়িত্ব দানে প্রয়াসী, তার আনুষঙ্গিক উপসর্গ হচ্ছে মুসলিম তমদুনের ধুয়া। আর তমদুন রক্ষার জন্যে প্রয়োজন ইসলামী সাহিত্য এবং তা মিলবে উর্দুভাষায় ও সাহিত্যে এবং আরবি ফরাসি শব্দে। আবার এই উর্দুভাষা ও আরবি-ফরাসি শব্দ অনায়াস আয়ত্তে পেতে হলে উর্দু হরফে (বিকল্পে রোমান হরফে) বাঙলা লেখা প্রয়োজন।
এ সহজ সদ্বুদ্ধি যদি কুফরী মন না-ই গ্রহণ করে, তবে অন্তত কিছু হরফ বর্জন করে, বানান সরল করে বাঙলা ভাষাকে বিকৃত কর, যাতে তা পৃথক রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গীয় কাফের-প্রভাব থেকে মুক্ত হয়। অতএব, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অভিপ্রায়, এবং সে-প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে হরফ বদলানো, বানান পাল্টানো, আরবি-ফারসি শব্দ বসানো প্রভৃতির অভিসন্ধি মূলত এই ষড়যন্ত্রে সিদ্ধি-লক্ষ্যে প্রযুক্ত। পোষা হাতি দিয়ে বুনো হাতি বাধার মতো এসব অপকর্মে যারা নিয়োজিত, তারা আমাদেরই পরিজন। এজন্যে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ সরল সাধারণ বাঙালির কাছে স্পষ্ট নয়। তাই তারা বিভ্রান্ত ও প্রতারিত।