ব্রাহ্মণ্যযুগে জীমূতবাহন, বল্লালসেন, রামনাথ, রঘুনাথ, রঘুনন্দন প্রভৃতি নবস্মৃতি ও নবন্যায় সৃষ্টি করে তাঁদের চিন্তার ঐশ্বর্যে ও প্রজ্ঞার প্রভায় জ্ঞানলোক সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল করেছেন।
মুসলিম আমলে চৈতন্যদেবের নবপ্রেমবাদ, সত্যপীর-কেন্দ্রী নবপীরবাদ, চাঁদ সদাগরের আত্মসম্মানবোধ ও তেজস্বিতা, বেহুলার বিদ্রোহ ও কৃচ্ছ্ব-সাধনা, গীতিকায় পরিব্যক্ত জীবনবাদ আমাদের সাংস্কৃতিক অনন্যতা ও বিশিষ্ট জীবনচেতনার সাক্ষ্য।
তারপরেও কী আমরা থেমেছি! রামমোহনের ব্রাহ্মমত, বিদ্যাসাগরের শ্ৰেয়োবোধ, ওহাবী ফরায়েজী মতবাদ, রবীন্দ্রনাথের মানবতা, নজরুল ইসলামের মানববাদ কী সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে দেয়নি?
মনীষা ও দর্শনের জগতে বাঙালি মীননাথ, কানপা, তিলপা, শীলভদ্র, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ, জীমূতবাহন, রঘুনাথ, রঘুনন্দন, রামনাথ,চৈতন্যদেব, রূপ-সনাতন-জীব-রঘুনাথাদি গোস্বামী, সৈয়দ সুলতান, আলাউল, হাজী মুহম্মদ, আলিরজা, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, কৃত্তিবাস-কাশীদাস রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন, তীতুমীর-শরীয়তুল্লাহ্-দুদুমিয়া, বঙ্কিম-রবীন্দ্র-প্রমথ-নজরুল নির্মাণ করেছেন বাঙালি মনীষার ও সংস্কৃতির গৌরব মিনার। এঁদের কেউ বলেছেন ঘরের ও ঘাটের কথা, কেউ জানিয়েছেন জগৎ ও জীবন-রহস্য; কারো মুখে শুনেছি প্রেম, সাম্য ও করুণার বাণী; কারো কাছে পেয়েছি মুক্তবুদ্ধি ও উদারতায় দীক্ষা; কেউবা শিখিয়েছেন ঘর বাঁধা ও ঘর রাখার কৌশল, কেউ শুনিয়েছেন ভোগের বাণী, কেউ জানিয়েছেন ত্যাগের মহিমা, আবার কেউ দেখিয়েছেন মধ্যপন্থার ঔজ্জ্বল্য। আত্মিক, আর্থিক, সামাজিক, পারমার্থিক সব চিন্তা, সব মন্ত্রই আমরা নানাভাবে পেয়েছি এদের কাছে।
বাঙালির বীর্য হানাহানির জন্যে নয়, তার প্রয়াস ও লক্ষ্য নিজের মতো করে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার। স্বকীয় বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে তত্ত্ব ও তথ্যকে, প্রতিবেশ ও পরিস্থিতিকে নিজের জীবনের ও জীবিকার অনুকূল ও উপযোগী করে গড়ে তোলার সাধনাতেই বাঙালি চিরকাল নিষ্ঠ ও নিরত। এই জন্যেই রাজনীতির তত্ত্বের (Theory) দিকটিই তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি–বাস্তব-প্রয়োজনে সে অবহেলাপরায়ণ; কেননা তাতে বাহুবল, ক্রুরতা ও হিংস্রতা প্রয়োজন। এজন্যেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বাঙালির মানস-সন্তান হলেও নেতৃত্ব থাকেনি বাঙালির। বিদেশাগত ভূঁইয়াদের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর ধরে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে জানমাল উৎসর্গ করতে বাঙালিরা দ্বিধা করেনি বটে, কিন্তু নিজেদের জন্যে স্বাধীনতা কিংবা সম্পদ কামনা করেনি। কিন্তু মননের ক্ষেত্রে সে অনন্য। নতুন কিছু করার আগ্রহ ও যোগ্যতা তার চিরকালের। প্রজারা যেদিন গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিল, ইতিহাসের এলাকায় সেদিন ভারতের মাটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক চিন্তার বীজ উপ্ত হল। সেদিন এ বিস্ময়কর পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রয়োগ কেবল বাঙালির পক্ষেই সম্ভব ছিল।
ওহাবী, ফরায়েজী ও সশস্ত্র বিপ্লবকালে বাঙালির বল ও বীর্য, ত্যাগ ও অধ্যবসায় বাঙালির গৌরবের বিষয়।
স্বাতন্ত্র আসে উৎকর্ষে, অনন্যতায় ও অনুপমতায়–বৈপরীত্যে ও বিভিন্নতায় নয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রও তার উৎকর্ষে, নতুনত্বে ও অনন্যতায়। আমাদের দুর্ভাগ্য ও লজ্জার কথা এই যে, ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিক্ষিত অধিকাংশ বাঙালি লেখাপড়া করে কেবল হিন্দু হয়েছে কিংবা মুসলমান হয়েছে, বাঙালি হতে চায়নি। হিন্দুরা ছিল আর্য-গৌরবের ও রাজপুত-মারাঠা বীর্যের মহিমায় মুগ্ধ ও তৃপ্ত এবং মুসলমান ছিল দূর অতীতের আরব-ইরানের কৃতিত্ব-স্বপ্নে বিভোর। এরা স্বাদেশিক স্বাজাত্য ভুলেছিল, বিদেশীর জ্ঞাতিত্ব গৌরবে ছিল তৃপ্তমন্য। এদের কেউ স্বস্থ ও সুস্থ ছিল না। তাই বাঙলা সাহিত্যে আমরা কেবল হিন্দু কিংবা মুসলমানই দেখেছি। বাঙালি দেখেছি ক্কচিৎ। এজন্যেই আমাদের সংস্কৃতি আশানুরূপ বিস্তার ও বিকাশ পায়নি। আজ বাঙালি পায়ের তলার মাটির সন্ধান নিচ্ছে। এই মাটিকে সে আপনার করে নিচ্ছে। এর মানুষকে ভাই বলে জেনেছে। আজ আর কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে সে চলে না। স্বদেশের ও স্বভাষার নামে পরিচিত হতে সে উৎসুক। দুর্যোগের তমসা অপগতপ্রায় প্রভাত হতে দেরী নেই সামনে নতুন দিন, নতুন জীবন। নিজেকে যে চেনে, অন্যকে জানা-বোঝা তার পক্ষে সহজ। আজ বাঙালি আত্মস্থ হয়েছে। তার আত্ম-জিজ্ঞাসা য়েছে প্রখর, সংহতি কামনা হয়েছে প্রবল। শিক্ষিত তরুণ বাঙালি জেগেছে, তাই সে তার ঘরের লোককে জাগাবার ব্রত গ্রহণ করেছে। বলছে বাঙালি জাগো। জাগ্রত মানুষই সংস্কৃতি চর্চা করে। এবার স্বস্থ ও প্রকৃতিস্থ বাঙালি জাগবে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাবে। জীবনে ও জগতে সে নতুনকে করবে আবাহন এবং নতুন ও ঋদ্ধ চেতনায় হবে প্রতিষ্ঠিত।
ভাষা প্রসঙ্গে : বিতর্কের অন্তরালে
০১.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভাষার প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। শিক্ষায় ও সম্পদে অগ্রসর সাবেক যুক্তপ্রদেশের নেতারা ও পদস্থ কর্মচারীরা এবং পাঞ্জাবের মুসলমান জমিদাররা ও পদস্থ চাকুরাই পাকিস্তানে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব লাভ করে। এদের ভাষা ছিল উর্দু। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো আঞ্চলিক বুলিই তখনো লেখ্য ভাষা হিসেবে প্রয়োজনানুরূপ বিকাশ পায়নি। তার উপর পাকিস্তানভুক্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনসমাজে তখনো অশিক্ষার অন্ধকার বিদ্যমান।