অনেককাল পরে এই ধারারই সাধক বাউলের মুখে শুনতে পাই :
সখিগো, জন্ম মৃত্যু যাহার নাই।
তাহার সনে প্রেম গো চাই।
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্বসার।
তীর্থব্রত যার জন্য
এ দেহে তার সব মিলে।
জীবনবাদী বাঙালি তাই বৌদ্ধ হয়েও মর্ত্যের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার বাঞ্ছায় অসংখ্য উপ ও অপদেবতার সৃষ্টি ও পূজা করেছে। সাংখ্যকেই সে তার দর্শনরূপে এবং যোগকেই তার সাধনপদ্ধতি রূপে গ্রহণ করেছে। তন্ত্রকেই সার বলে মেনেছে। দেহে-মনে আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠাকেই। জীবনকাঠি বলে জেনেছে। আর যোগ-তান্ত্রিক কায়া-সাধনার মাধ্যমে সে কামনা করেছে দীর্ঘ জীবন ও অমরত্ব। এ জীবনকে সে প্রত্যক্ষ করেছে চলচঞ্চল ও তরঙ্গভঙ্গে লীলাময় মন-পবনের নৌকারূপে। বৌদ্ধ যুগে তার সাধনা ছিল নির্বাণের নয়–বাঁচার, কেবল মাটি আঁকড়ে বাঁচার। মন ভুলানো ভুবনের বনে বনে, ছায়ায় ছায়ায়, জলে-ডাঙায় ভালবেসে, প্রীতি পেয়ে মমতার মধুর অনুভূতির মধ্যে বেঁচে থাকার আকুলতাই প্রকাশ করেছে সে জীবনব্যাপী। হরগৌরীর মহাজ্ঞান, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িফা-কানুফা, ময়নামতী-গোপীচাঁদ প্রভৃতির কাহিনীর মধ্যে আমরা এ তত্ত্বই পাই। অবশ্য এ বাঁচা স্কুল ও জৈবিক ভোগের মধ্যে নয়, ত্যাগের মধ্যে সূক্ষ্ম, সুন্দর ও সহজ মানসোপভোগের মধ্যে বাঁচা। কিন্তু এই জীবন-সত্যে সে কী নিঃসংশয় ছিল?–মনে হয় না। তাই বিলুপ্ত যোগীপাল, ভোগীপাল, মহীপাল গীতে তার দ্বিধা ও মানস-দ্বন্দ্বের আভাস পাই। পাল আমলের গীতে মনে হয়, সে মধ্যপন্থা (golden mean) অবলম্বন করেছে। যোগেও নয়, ভোগেও নয়, মর্ত্যকে ভালবেসে দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই যেন সে বাঁচতে চেয়েছে, চেয়েছে জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে। তার সেই জানা-বোঝার সাধনায় আজও ছেদ পড়েনি। বাউলেরা তাই গৃহী, যোগীরা তাই অমরত্বের সাধক, বৈষ্ণব বৈরাগীরা তাই ঘর করে, আর ফকিরেরা বাঁধে ঘর।
সেন আমলে এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রবল হয়। লুপ্তপ্রায় বৌদ্ধসমাজ বর্ণে বিন্যস্ত হয়ে বল্লালসেনের নেতৃত্বে উগ্র ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে তোেলে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। গীতা-স্মৃতি উপনিষদের মত সে মুখে গ্রহণ করলেও মনে মানেনি। তার ঠোঁটের স্বীকৃতি বুকের বাণী হয়ে উঠেনি। কেননা সে ধার করে বটে, কিন্তু জীবনের অনুকূল না হলে অনুকরণ কিংবা অনুসরণ করে না। তাই সে তার প্রয়োজনমতো জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার প্রতীক দেবতা সৃষ্টি করে পূজা করেছে, আশ্বস্ত হতে চেয়েছ ঘরোয়া ও মানস জীবনে। তার মনসা, চণ্ডী, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি তার স্বসৃষ্ট দেবতা। জীবনের সামাজিক সমস্যার সমাধানে ও অধ্যাত্মজীবনের বিকাশ সাধনে সে আরো এগিয়ে এসেছে। জীমূতবাহন ও বল্লালসেন, রঘুনাথ, রামনাথ প্রভৃতির স্মৃতি ও ন্যায় দৈবকী বানন্দ-পঞ্চাননের মেল-পটি প্রভৃতি গোত্র ও বর্ণবিন্যাস প্রয়াস, চৈতন্যের ভগবৎপ্রেম ও মানব প্রীতিবাদ বাঙালি জীবনে রেনেসাঁস আনে। এবং তার প্রসাদে আপামর বাঙালির দেহ-মন-আত্মা গ্লানিমুক্ত হয়। এ নতুন কিছু ছিল না, গৌতমের করুণা ও মৈত্রীতত্ত্বের ঐতিহ্যে সূফীমতের প্রভাবেই মানব-মহিমা বাঙালি চিত্তে নতুন মূল্যে ও ঔজ্জ্বল্যে প্রতিভাত হয়। বাঙালি নতুন করে জীবে ব্রহ্ম এবং নরে নারায়ণ দর্শন করে। তখন বাঙালির মুখে উচ্চারিত হয় মানুষের মর্যাদা ও মনুষ্যত্বের মহিমা চণ্ডালেহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ।–মানবিক সম্ভাবনার এ স্বীকৃতি সেদিন জীবন-বিকাশের নিঃসীম দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। তাই বাঙালির কণ্ঠে আমরা সেদিন শুনতে পেয়েছিলাম চরম সত্য ও পরম কাম্য বাণী–শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
বাঙালি এই ঐতিহ্য আজও হারায়নি। আজো হাটে-ঘাটে-প্রান্তরে বাউলকণ্ঠে সেই বাণী শুনতে পাই। মানববাদী বাউলেরা আজো উদাত্তকণ্ঠে মানুষকে মিলন-ময়দানে আহ্বান জানায়, আজো তারা মানবতার শ্রেষ্ঠ সাধক ও চিন্তানায়কের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্য, সহঅবস্থান ও সম্প্রীতির বাণী শোনায়। তারা বলে :
নানা বরণ গাভীরে ভাই
একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
একই মায়ের পুত।
কাজেই কাকেই বা দূরে ঠেলবি আর কাকেই বা কাছে টানবি! তোরা তো ভাই ফুল কুড়োতে কেবল ভুলই কুড়োচ্ছিস। কৃত্রিম বাছ-বিচারের ধাঁধায় কেবল নিজেকেই ঠকাচ্ছিস। গোত্রীয়, ধর্মীয় ও দেশীয় চেতনা বিভেদের প্রাচীরই কেবল তৈরি করেছে বিদ্বেষ ও বিবাদ সৃষ্টি করেছে, হানাহানির প্রেরণাই কেবল দিয়েছে, তাই বাউল বলেন :
যদি
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান।
নারী লোকে কী হয় বিধান?
বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনী চিনি কী করে?
একালের ইংরেজি শিক্ষিত কবি যখন বলেন :
সবারে তুই বাসরে ভাল, নইলে তোর মনের কালি ঘুচবে না রে।
কিংবা –
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবার সমান রাঙা
অথবা,–
গাহি সাম্যের গান।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই।
নহে কিছু মহীয়ান;
তখন তা আমাদের কাছে নতুন ঠেকে না। কেননা প্রকৃত বাঙালির অন্তরের বাণী স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হতে দেখেছি আমরা কত কত কাল আগে।
ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলনের পূর্বে এখানে শরীয়তী ইসলামও তেমন আমল পায়নি। একপ্রকার লৌকিক তথা দেশজ ইসলামই লোকের অবলম্বন হয়েছিল। তখন পার্থিব জীবনের স্বস্তির ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য কল্পিত হয়েছিলেন দেব-প্রতিম পাঁচগাজী ও পাঁচপীর। নিবেদিত চিত্তের ভক্তি লুটেছে খানকা, অর্ঘ্য পেয়েছে দরগাহ্ আর শিরনী পেয়েছেন দেশের সেনানী-শাসক জাফর-ইসমাইল-খান জাহান-গাজীরা এবং বিদেশাগত বদর-আলম-জালাল-সুলতান প্রভৃতি সুফীরা, তার পরেও প্রয়োজন হয়েছিল সত্যপীর-খিজির-বড়খা-গাজী-কালু-বনবিবি-ওলাবিবি প্রভৃতি দেবকল্প কাল্পনিক পীরের। এঁরা বাঙালির ঐহিক জীবনের নিয়ন্তা দেবতা। জীবনবাদী বাঙালি এঁদের উপর ভরসা করেই সংসার-সমুদ্রে ভাসাত জীবন-নৌকা। এখানেই শেষ নয়। চিন্তাজগতে বাঙালি চিরবিদ্রোহী। বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও মুসলিম ধর্ম সে নিজের মতো করে গড়তে গিয়ে যুগে যুগে সে চিন্তাজগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাহ্যত সে ভাববাদী হলেও, উপযোগ-তত্ত্বেই তার আস্থা ও আগ্রহ অধিক।– বৌদ্ধযুগে বৌদ্ধ বজ্রমান-সহজযান-কালচক্রযান, থেরবাদ, অবলোকিতেশ্বর ও তারা দেবতার প্রতিষ্ঠা এবং যোগতান্ত্রিক সাধনায় বিকাশ সাধন করে সে তার স্বকীয়তার, সৃষ্টিশীলতার, মনন বৈচিত্র্যের ও স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর রেখে গেছে।