বাঙালির ধর্মতত্ত্বে পাপ-পুণ্যের কথা বেশি নেই। অনেক করে রয়েছে জীবন-রহস্য জানবার ও বুঝবার প্রয়াস। লোক-জীবনে সে-প্রয়াস আজো অবিরল। মনে হয় দারিদ্রক্লিষ্ট লোক-জীবনের যন্ত্রণামুক্তির অবচেতন অপপ্রয়াসে অসহায় মানুষ অধ্যাত্মতত্ত্বে স্বস্তি ও শক্তির, প্রবোধ ও প্রশান্তির প্রশ্রয় কামনা করেছে। এভাবে পার্থিব পরাজয়ের ও বঞ্চনার ক্ষোভ ও বেদনা ভুলবার জন্যে আসমানী-চিন্তার মাহাত্ম-প্রলেপে বাস্তবজীবনকে আড়াল করে ও তুচ্ছ জেনে মনোময় কল্পনোক রচনা করে এই নির্মিত ভুবনে বিহার করে আনন্দিত হতে চেয়েছে দুস্থ ও দুঃখী মানুষ। আজো গরিবঘরের প্রতারিত-বঞ্চিত সেই মানুষ উদারকণ্ঠে সেই উদাস গান গায়। তার জৈব প্রয়োজনের সামগ্রীই হয়েছে তার সেই ভাবের জীবনের রূপক। এ-ই হয়তো দুঃখ দীর্ণ, দ্বন্দ্ব-ভীরু পলাতক মনের অভয় আশ্রয়, হয়তো বা পিছিয়ে-পড়া মানুষের প্রতিহত কাম্যজীবনের স্বাপ্নিক প্রকাশ অথবা আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষের অবচেতন কামনার বিদেহী গুঞ্জন।
বাঙালির সংস্কৃতি
অন্যান্য প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য এই যে, অন্য প্রাণী প্রকৃতির অনুগত জীবন ধারণ করে আর মানুষ নিজের জীবন রচনা করে। প্রকৃতিকে জয় করে, বশীভূত করে প্রকৃতির প্রভু হয়ে সে কৃত্রিম জীবন যাপন করে– এ-ই তার সংস্কৃতি ও সভ্যতা। অতএব, এইভাবে জীবন রচনা করার নৈপুণ্যই সংস্কৃতি। স্বল্প কথায় সুন্দর ও সামগ্রিক জীবনচেতনাই সংস্কৃতি। চলনে-বলনে, মনে-মেজাজে, কথায়-কাজে, ভাবে-ভাবনায়, আচারে-আচরণে অনবরত সুন্দরের অনুশীলন ও অভিব্যক্তিই সংস্কৃতিবানতা। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি অসুন্দর, অকল্যাণ ও অপ্রেমের অরি। সুরুচি ও সৌজন্যেই তাই সংস্কৃতিবানতার প্রকাশ। সংস্কৃতিবান মানুষ কখনও জ্ঞাতসারে অন্যায় করে না, অল্যাণকর কিছুকে প্রশ্রয় দেয় না, অপ্রীতিতে বেদনাবোধ করে এবং কৌৎসিত্যকে সহ্য করে না। অন্য কথায়, যেখানে কথার শেষ সেখানেই সুরের আরম্ভ, যেখানে Photography-র শেষ সেখান থেকেই শিল্পের শুরু, নক্সার উধ্বেই সাহিত্যের স্থিতি, তেমনি যেখানে স্কুল জৈব প্রয়োজনের শেষ, সেখান থেকেই সংস্কৃতির শুরু। সংস্কৃতিবান মানুষ জ্ঞানে-প্রজ্ঞায়, অভিজ্ঞতায় ও প্রয়োজনবোধে চালিত হয়ে অনবরত জীবনকে রচনা করতে থাকে এবং পরিবেশকে স্নিগ্ধ ও সুন্দর করবার প্রয়াসী হয়। এজন্যে সংস্কৃতিবান ব্যক্তিমাত্রেই কেবল নিজের প্রতি নয়, প্রতিবেশীর প্রতিও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বীকার করে। এবং সচেতনভাবে ও সযত্নে নিজেকে সুন্দর করে, সৃষ্টি করে এবং নিজের আচারে আচরণে, মনে-মননে, কথায়-কাজে অপরের পক্ষে স্মরণীয়, বরণীয়, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও আকর্ষণীয় লাবণ্য ছড়িয়ে তৈরি করে প্রতিবেশীদের সুষ্ঠু জীবনের ভিত্।
বীজের আত্মবিকাশের জন্যে যেমন কৰ্ষিত ক্ষেত্র প্রয়োজন, সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের জন্যেও তেমনি সুকর্ষিত মনোভূমি তথা পরিস্রত চেতনা আবশ্যক। তাই সংস্কৃতির স্রষ্টামাত্রেই বিজ্ঞ ও বিবেকবান, সুন্দরের ধ্যানী ও আনন্দের অন্বেষ্টা, বুদ্ধি ও বৃদ্ধির সাধক,মঙ্গল ও মমতার বাণীবাহক এবং প্রীতি ও প্রফুল্লতার উদ্ভাবক।
চরিত্রবল, মুক্তবুদ্ধি ও উদারতার ঐশ্বর্যই এমন মানুষে সম্বল ও সম্পদ। বেদনা-মুক্তি ও আনন্দ-অন্বেষাই মানুষের জীবনসত্য। এক্ষেত্রে সিদ্ধির জন্যে প্রয়োজন সুন্দর ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠা। আর এই সৌন্দর্য-অন্বেষা ও কল্যাণকামিতাই সংস্কৃতি। . মানুষের জীবনে সম্পদ ও সমস্যা, আনন্দ ও যন্ত্রণা পাশাপাশি চলে, বলা যায় একটি অপরটির সহচর। কিন্তু এগুলো যখন আনুপাতিক ভারসাম্য হারায়, তখন সুখ কিংবা দুঃখ বাড়ে। সুখ বৃদ্ধি পেল তো ভালই, কিন্তু সমস্যা ও যন্ত্রণার চাপে যখন জীবন-জ্বালা আত্যন্তিক হয়ে উঠে, তখনই বিচলিত-বিপর্যস্ত মানুষ স্বস্তি কামনায় সমাধান খোঁজে। এ সমাধান দিতে পারেন এবং দেনও কেবল সংস্কৃতিবান মানুষই।
মানুষ মাত্রেই সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে সংস্কৃতিকামী। কিন্তু সাধনার মাত্রা ও পথ পদ্ধতি সবার এক রকম নয়। তাই সংস্কৃতিতে আসে গৌত্রিক, আঞ্চলিক, সামাজিক, আর্থিক ও আত্মিক বৈষম্য ও বিভিন্নতা। এবং স্তরভেদে তা হয় নিন্দনীয় কিংবা বন্দনীয়, অনুকরণীয় কিংবা পরিহার্য।
আগের কথা জানিনে, কিন্তু ইতিহাসান্তৰ্গত যুগে দেখতে পাই বাঙালি মনোভূমি কর্ষণ করেছে সযত্নে। এবং এই কর্ষিত ভূমে মানবিক সমস্যার বীজ বপন করে সমাধানে ফল ও ফসল পেতে হয়েছে উৎসুক। এই এলাকায় বাঙালি অনন্য। এ যেন তার নিজের এলাকা, সে এই মাটিকে। ভালবেসেছে, সে এ জীবনকে সত্য বলে জেনেছে। তাই সে দেহতাত্ত্বিক, তাই সে প্রাণবাদী, তাই সে যোগী ও অমরত্বের পিপাসু। এজন্যেই নির্বাণবাদী বুদ্ধের ধর্মগ্রহণ করেও সে কায়া সাধনায় নিষ্ঠ। তার কাছে এ মর্ত্যজীবনই সত্য, পারত্রিক জীবন মায়া। মর্ত্যজীবনের মাধুর্যে সে আকুল, তাই সে মর্ত্যে অমৃতসন্ধানী। সে বিদ্রোহী, সে বলে :
কিংতো দীবে কিংতো নিবেজেঁ
কিংতো কিজ্জই মন্তহ সেব্ব।
কিংতো তিথ-তপোবন জাই।
মোখক কী লবভই পানী হ্নাই।
–কী হবে তোর দীপে আর নৈবেদ্যে? মন্ত্রের সেবাতেই বা কী হবে তোর, তীর্থ-তপোবনই। বা তোকে কী দেবে? পানিতে স্নান করলেই কী মুক্তি মেলে?