…… চিশতীয় ও সুহরদীয়হ সম্প্রদায়দ্বয়ের সাধনা, ভারতে আগমন করার পূর্ব হইতেই অনেকখানি ভারতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। ভারতে আগমনের পর, এদেশীয় সাধনার সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ যোগসূত্রের সৃষ্টি হইল; ভারতের প্রাণের সহিত আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটিয়া গেল। ভারতবিখ্যাত সাধক কবীর (১৩৯৮-১৪৪০ খ্র.) উক্ত প্রাণত্রয়ের পুণ্যতীর্থ প্রয়োগক্ষেত্রে পরিণত হইলেন। তাঁহার মধ্যে ভারতীয় যোগ সাধনা ও সূফীদের তস্ববফ বা ব্রহ্মবাদ সম্মিলিত হইল। সূফীরা সাক্ষাত্তাবে তাহার ভিতর দিয়া ভারতীয়দের আর ভারতীয়েরা সূফীদের প্রাণের সন্ধান লাভ করিলেন।
আইন-ই-আকবরীতে চৌদ্দটি সূফী খান্দান বা মণ্ডলীর উল্লেখ আছে। আবুল ফজল হয়তো প্রধান সম্প্রদায়গুলোরই নাম করেছেন। আমাদের অনুমানে তখন এক এক পীর-কেন্দ্রী এক এক সম্প্রদায় ছিল। পরে তাত্ত্বিক ও আচারিক বিধিবদ্ধ শাস্ত্র গড়ে উঠার ফলে সম্প্রদায়-সংখ্যা কমেছে এবং চারটি প্রধান মতবাদী খান্দান প্রসার লাভ করে। আর অপ্রধানগুলো কালে লোপ পায়, অথবা স্থানিক সীমা অতিক্রমণের যোগ্যতা হারায়। এ কারণেই আবুল ফজল কথিত চৌদ্দটি খান্দানের অনেকগুলোই লোপ পেয়েছে।
চিশতিয়া ও সুহরওয়ার্দিয়া মতই প্রথমে ভারতে তথা বাঙলায় প্রসার লাভ করে।৪৪ এরপরে নক্শবন্দিয়া এবং আরও পরে কাদিরিয়া সম্প্রদায় জনপ্রিয় হয়। মনে হয় ষোলো শতক অবধি চিশতিয়া, মদারিয়া ও কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবই বেশি ছিল। মদারিয়া ও কলন্দরিয়া মত একসময় জনপ্রিয়তা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
চৌদ্দ-পনেরো শতকের মধ্যেই সূফীর সর্বেশ্বরবাদ আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ অভিন্নরূপ নিল। আচার ও চর্যার ক্ষেত্রেও যোগপদ্ধতির মাধ্যমে ঐক্য স্থাপিত হল.। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ অভিন্নতা প্রথম আমরা কবীরের (১৩৯৮-১৪৪৮) মধ্যেই প্রত্যক্ষ করি। এই মিলন-বিরোধী আন্দোলনও শতোকঁ বছর পর মুজদ্দদ-ই-আলফ-ই-সানী আহমদ সরহিন্দীর (১৫৬৩-১৬২৪) নেতৃত্বে গড়ে উঠে। কিন্তু সে-সংস্কার আন্দোলন সর্বব্যাপী হতে পারেনি। নকশবন্দিয়া এবং কিছুটা কাদিরিয়া। সম্প্রদায়েই এ সংস্কার আন্দোলন প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। আলফসানী স্বয়ং একজন নকশবন্দিয়া।
বাঙলায় এ আন্দোলন দেশী তত্ত্ব চিন্তা ও চর্যার সঙ্গে ইসলামের বহির্বয়বের মিলন ঘটানোর চেষ্টায় পরিণতি লাভ করে। সৈয়দ সুলতান ও তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে এই প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করি।
ভারতীয় যোগ-চর্যা ভিত্তিক তান্ত্রিক সাধনার যা-কিছু মুসলিম সূফীরা গ্রহণ করলেন, তাকে একটা মুসলিম আবরণ দেবার চেষ্টা হল, তা অবশ্য কার্যত নয় নামত। কেননা আরবি-ফারসি পরিভাষা গ্রহণের মধ্যেই এর ইসলামী রূপায়ণ সীমিত রইল। যেমন : নির্বাণ হল ফানা, কুণ্ডলিনীশক্তি হল নকশাবন্দিয়াদের লতিফা। হিন্দুতন্ত্রের ষড় পদ্ম হল এদের ষড় লতিফা বা আলোক-কেন্দ্র। এদেরও অবলম্বন হল দেহ চর্যা ও দেহস্থ আলোর উধ্বায়ন। পরম আলো বা মৌল আলোর দ্বারা সাধকের সর্বশরীর আলোময় হয়ে উঠে। এ হচ্ছে এক আনন্দময় অদ্বয়সত্তা-এর সঙ্গে সামরস্য জাত সহজাবস্থার, সচ্চিদানন্দ বা বোধিচিত্তাবস্থার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সূফীর জিকির ভারতিক প্রভাবে যোগীর ন্যাস, প্রাণায়াম ও জপের রূপ নিল। বর্হিভারতিক বৌদ্ধ-প্রভাবে (ইরানে, সমরখন্দে, বোখারায়-বলখে) এবং ভারতিক বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবে বৌদ্ধ গুরুবাদও যোগতান্ত্রিক সাধকদের অনুসৃতি বশে সূফী সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠল। সূফী মাত্রই তাই পীর-মুর্শিদ-নির্ভর তথা গুরুবাদী। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ। এটিই পরিণামে কবর পূজারও (দরগাহ্ বৌদ্ধ ভিক্ষুর স্তূপ পূজারই মতো হয়ে উঠল) রূপ পেল। সূফীরা আল্লাহর ধ্যানের প্রাথমিক অনুশীলন হিসেবে পীরের চেহারা ধ্যান করা শুরু করেন। শুরুতে বিলীন হওয়ায় অবস্থার উন্নীত হলেই শিষ্য আল্লাহতে বিলীন হওয়ার সাধনার যোগ্য হয়। প্রথম অবস্থার নাম ফানা-ফিশ-শেখ, দ্বিতীয় স্তরের নাম ফানা ফিল্লাহ। প্রথমটি রাবিতা (গুরুসংযোগ), দ্বিতীয়টি মুরাকিবাহু (আল্লাহর ধ্যান)। এই মুরাকিবায় যৌগিক পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। আসন, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই চতুরঙ্গ যোগ পদ্ধতি থেকেই পাওয়া। পীরের খানকা বা আখড়ায়। সামা (গান), হালকা (ভাবাবেগে নর্তন), দারা (আল্লার নাম কীর্তনের আসর), হাল (অভিভূতি), সাকী, ইশক প্রভৃতি খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর আমল থেকেই চিশতিয়া খান্দানের সূফীদের সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। পরবর্তীকালে নিজামিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়েও এ রীতি গৃহীত হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনায় এরই অনুসৃতি রয়েছে।
সূফীদের দ্বারা দীক্ষিত অজ্ঞ জনসাধারণ শরীয়তী ইসলামের সঙ্গে ভাষার ব্যবধ্বন বশত অনেককাল পরিচিত হতে পারেনি। ফলে, তাহারা ক্রিয়াকলাপে আচার ব্যবহারে, ভাষায় ও লিখায়, সর্বোপরি সংস্কার ও চিন্তায় প্রায় পুরোপুরি বাঙালিই রহিয়া গেল। এমনকি হিন্দুত্বকে পুরোপুরি বর্জন করিতে পারিল না।
দরবেশদের প্রশ্রয়ও ছিল–তাহারা (দরবেশরা) কখনও বাহ্যিক আচার বিচারের প্রতি বিশেষ মনোযোগও দেনই নাই, এমনকি আভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অসাধারণ মহৎ ও উদার ছিলেন। …. এখনও পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গীয় শয়খ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে অনেক হিন্দু ভাব, চিন্তা ও ব্যবহারের বহুল প্রচলন রয়েছে)। সাধারণ বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এখনও তাহাদের ভারতীয় পিতৃপুরুষ হইতে লব্ধ বা পরবর্তীকালে গৃহীত যত হিন্দু ও বৌদ্ধ আচার ব্যবহার প্রচলিত আছে এবং চিন্তা ও বিশ্বাস ক্রিয়া করিতেছে।
বাঙলার ধর্ম
সাংখ্য ও যোগ –এই দুই শাস্ত্র ও পদ্ধতি যে আদিম অনার্য দর্শন ও ধর্ম তা আজকাল কেউ আর অস্বীকার করে না। এ শাস্ত্র অস্ট্রিক কিংবা বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিরাত জাতির মনন-উদ্ভূত, তা নিশ্চয় করে বলবার উপায় নেই। তবে উভয় গোত্রীয় লোকের মিশ্র-মননে যে এর বিকাশ এবং আর্যোত্তর যুগে যে এর সর্বভারতীয় তথা এশীয় বিস্তার, তা একরকম সুনিশ্চিত।