মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাগীর সিমনানী শেখ আলাউল হকের শিষ্য ছিলেন। এঁর চিঠিগুলো সেকালের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ ও নির্ভরযোগ্য দলিল। সৈয়দ আশরাফ সিমনানী জৌনপুর সুলতান ইব্রাহীম সৰ্কীর সমসাময়িক ছিলেন। সিমনানী ইব্রাহীম সকীকে লিখিত এক পত্রে বদর আলম ও বদর আলম জাহিদী নামে দুইজন সূফীর উল্লেখ করেছেন। শেখ হোসেন ধুক্কারপোশ (Dhukkarposh)-এর ছেলে রাজা গণেশ কর্তৃক নিহত হলে সিমনানী তাঁকে প্রবোধ দিয়ে যে পত্র লেখেন, তা থেকে আভাস মিলে যে, গণেশ কিছু সোহরাওয়ার্দীয়া ও রুহানিয়া সূফীকে হত্যা করেন। Those who Traverse the path of God, have many calamities to suffer from. It is hoped through the spiritual grace of the souls of Suhrawardia and Ruhania saints of the part, of that in near future that kingdom of Islam will be free from the hands of the luckless nonbelievers.us
শেখ বদরুল ইসলাম নূর কুতুব-ই-আলমের সমসাময়িক। রিয়াজুস-সালতিন৩২-এ বর্ণিত ঘটনায় প্রকাশ : রাজা গণেশের দরবারে ইনি রাজাকে অভিবাদন না করেই আসন গ্রহণ করেন। রুষ্ট রাজা তাঁকে হত্যা করে তার ঔদ্ধত্যের শাস্তি দেন।
এঁরা ছাড়া শাহ্ সফিউদ্দীন, জাফর খান গাজী৩৩ খাঁ জাহান আলী, শাহু আনোয়ার কুলি হালবী, ইসমাইল গাজী, মোল্লা আ, শাহ জালাল দাখিনী (মৃত্যু ১৪৭৬ খ্র.), শাহ মোয়াজ্জম দানেশমন্দ ওর্কে মৌলানা শাহ্ দৌলা (রাজশাহী : বাঘা), শাহ আলী বাগদাদী (মীরপুর, ঢাকা), শেখ ফরিদউদ্দীন শাহ্, লঙ্গর শাহ নিয়ামতুল্লাহ, শাহ লঙ্কাপতি প্রভৃতি দরবেশের নাম উল্লেখ্য।
জালালুদ্দীন তাবরেজী (মৃত্যু ১২২৫ খ্রী.), মখদুম জাহানিয়া (১৩০৭-৮৩) ও শাহজালাল কুনিয়াঈ (মৃত্যু ১৩৪৬) সোহরাওয়ার্দীয়া মতবাদী ছিলেন।
শেখ ফরিদউদ্দিন শখরগঞ্জ (১১৭৬-১২৬৯), আখি সিরাজুদ্দীন (মৃ. ১৩৫৭), আলাউল হক (মৃ. ১৩৯৮), শেখ নাসিরুদ্দীন মানিকপুরী, মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাগীর সিমনানী, শেখ নুর কুতুব-ই-আলম (মৃ. ১৪১৬), শেখ জাহিদ প্রমুখ চিশতিয়া সম্প্রদায়ের সূফী ছিলেন।
শাহ সফীউদ্দিন (মৃত্যু ১২৯০-৯৫?) কলন্দরিয়া সূফী ছিলেন।
শাহ্ আল্লাহ্ মদারিয়া এবং শেখ হামিদ দানিশমন্দ নকশবন্দিয়া সূফী ছিলেন।৪০ ষোলো শতক অবধি চট্টগ্রামের সূফী শাহ্ সুলতান বল্খী (বায়জিদ?), শেখ ফরিদ, পীর বদর আলাম, কাতাল পীর, শাহ মসন্দর বা মোহসেন আউলিয়া, শাহপীর, শাহাদ প্রমুখ এবং কবি মুহম্মদ খানের মাতৃকূলের পীর শরফউদ্দীন থেকে সদরজাহা আবদুল ওহাব ওর্ষে শাহ ভিখারী অবধি অনেক পীর প্রখ্যাত।
গৌড়ের সুলতানদের মধ্যে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্, সিকান্দর শাহ্, গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ্, জলালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্ (যদু), রুকনুদ্দীন বারবক শাহ্ প্রমুখের দরবেশ ভক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আবার শাহ্ জালালউদ্দীন কুনিয়াঈ, আলাউল হক, নুর কুতুব-ই-আলম, আশরাফ জাহাগীর সিমনানী, ইসমাইল গাজী, জাফর আলী খা, খান জাহান খান প্রমুখ সূফীরা রাজনীতি ও সরকারি কর্মে নিযুক্ত ছিলেন।
আর্তের সেবা, কাঙাল ভোজন, রোগীর চিকিৎসা ও কেরামতি প্রভৃতি দ্বারাই সূফীরা গণমন জয় করেন।
.
০২.
মুসলমানদের বিশ্বাস : হযরত মুহম্মদ হজরত আলীকে তত্ত্ব বা গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান। হাসান, হোসেন, খাজা কামীল বিন জয়ীদ ও হাসান বসরী সে-জ্ঞান আলী থেকে প্রাপ্ত হন। এই কিংবদন্তির কথা বাদ দিলে হাসান বসোরী (মৃ. ৭২৮ খ্র.), রাবিয়া (মৃ. ৭৫৩), ইব্রাহীম আদহম (মৃ. ৭৭৭), আবু হাশিম (মৃ. ৭৭৭), দাউদ তায়ী (মৃ ৭৮১), মারুফ করখী (মৃ ৮৫) প্রমুখই সূফী মতের আদি প্রবক্তা।
পরবর্তী সূফী জুননুন মিশরী (মৃ. ৮৬০), শিবলী খোরাসানী (মৃ. ৯৪৬), জুনাইদ বাগদাদী (মৃ. ৯১০) প্রমুখ সাধকরা সূফীমতকে লিপিবদ্ধ, সুশৃঙ্খলিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। আল্লাহ আকাশ ও মর্ত্যের আলো স্বরূপ। আমরা তার (মানুষেরা) ঘাড়ের শিরা থেকেও কাছে (রয়েছি)। –এই প্রকার ইঙ্গিত থেকেই সূফীমত বিশ্বব্রহ্ম বা সর্বেশ্বরবাদের তথা অদ্বৈতবাদের দিকে এগিয়ে যায়। জিকর বা জপ করার নির্দেশ মিলেছে কোরানের অপর এক আয়াতে অতএব (আল্লাহকে) স্মরণ কর। কেননা তুমি একজন স্মারক মাত্র।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার অদৃশ্য লীলা ও অস্তিত্ব বুঝবার জন্যে বোধি তথা ইরফান কিংবা গুহ্যজ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। এ প্রয়োজনবোধ ও রহস্যচিন্তাই সূফীদের বিশ্বব্রহ্মবাদী বা সর্বেশ্বরবাদী করেছে। এই চিন্তা বা কল্পনার পরিণতিই হচ্ছে হমহউস্ত (সবই আল্লাহ্) বিশ্বব্রহ্মতত্ত্ব তথা সর্বং খন্বিদং ব্রহ্মতত্ত্ব। এই হল তৌহিদ-ই-ওজুদী তথা আল্লাহ্ সর্ব ভূতে বিরাজমান–এই অঙ্গীকারে আস্থা স্থাপন।
বায়জিদ, জুনাইদ বাগদাদী, আবুল হোসেন ইবনে মনসুর হল্লাজ এবং আবু সৈয়দ বিন আবুল খয়ের খোরাসানী (মৃত্যু ১০৪৯ খ্র.) প্রমুখ প্রথম যুগের অদ্বৈতবাদী সূফী। শরীয়তপন্থ বিরোধী এসব সূফীদের অনেককেই নতুন মত পোষণ ও প্রচারের জন্যে প্রাণ হারাতে হয়। মনসুর হল্লাজ, শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল্লাহ প্রমুখ এভাবেই শহীদ হন।
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন–ভারতে সূফী প্রভাব পড়িবার পূর্ব হইতে, সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট হইতে থাকে। খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই ভারতে সূফীমত প্রবেশ করে। তৎপর্বের সূফীমতেও ভারতীয় দর্শন ও চিন্তাধারার স্পষ্ট চাপ দেখিতে পাই। তার মতে এ প্রভাব পড়ে ভারতীয় পুস্তকের আরবি-ফারসি অনুবাদের মাধ্যমে ও ভ্রাম্যমাণ বৌদ্ধভিক্ষুর সান্নিধ্যে। এবং আলবিরুনীর অনুবাদ, পাতঞ্জল যোগ এবং কপিল সাংখ্য তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়ই এ প্রভাবের মুখ্য কারণ। বায়জিদ বোস্তামীর ভারতীয় (সিন্ধু দেশীয়) গুরু বুআলীর প্রভাবও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। তিনি আরও বলেন, (বাঙলা) দেশে সূফীমত প্রচার ও বহুল বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সহজিয়া ও যোগ সাধন প্রভৃতি পন্থা, বঙ্গের সূফীমতকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে থাকে। কালক্রমে বাঙলার সূফী মতবাদের সহিত এদেশীয় সংস্কার, বিশ্বাস প্রভৃতিও সম্মিলিত হইতে থাকে। এবং সূফীমতবাদ ও সাধনপদ্ধতি ক্রমে ক্রমে যোগসাধন প্রভৃতি হিন্দুপদ্ধতির সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে থাকে।