চট্টগ্রামের পীর বদরুদ্দীন বদর-ই-আলম, বর্ধমানের কালনার বদর সাহিব, দিনাজপুরের হেমতাবাদের বদরুদ্দীন এবং বদর-মোকান খ্যাত বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া আর মাঝিমাল্লার পাঁচপীরের অন্যতম পীর বদর সম্ভবত অভিন্ন ব্যক্তি। চট্টগ্রামে এর অবস্থিতিকাল কারো মতে ১৩৪০ আর কারো ধারণায় ১৪৪০ খ্রীস্টাব্দ।
শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজীর নাম শেকশুভোদয়ার সঙ্গে জড়িত। কেউ কেউ একে জাল গ্রন্থ বলে বিবেচনা করেন। এই গ্রন্থের লেখক হলায়ুধ মিশ্র রাজা লক্ষ্মণ সেনের সচিব ছিলেন। তিনি যদি ১২১০-১২ খ্রীস্টাব্দের পর বেঁচে থাকেন, তাহলে শেখ শুভোদয়া তাঁর রচনা হওয়া সম্ভব। তবে স্বীকার করতে হবে যে ভাষার বিকৃতি ও প্রক্ষিপ্ত তথ্যে গ্রন্থটি বিদ্বানদের বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে। ইতিহাস-বিরল সে-যুগে গ্রন্থকার হিসেবে হলায়ুধ মিশ্রের ও শাসকরূপে লক্ষ্মণ সেনের নাম জড়িয়ে, আর্যা প্রভৃতির প্রাচীনরূপ রক্ষা করে মোলো-সতেরো শতকে জালগ্রন্থ রচিত হয়েছে, অনুমান করতে অনেকখানি কল্পনার প্রয়োজন। শেখ শুভোদয়া সূত্রে কারো কারো বিশ্বাস, শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী লক্ষ্মণ সেনের আমলে লখনোতিতে তথা বাঙলায় বাস করতেন। অমৃতকুণ্ড তাঁরই আগ্রহে অনূদিত হয়। তাঁরাই মাহাত্ম্য-মুগ্ধ হলায়ুধ মিশ্র তাঁর কৃতিকথা বর্ণনা করেছেন শেখ শুভোদয়ায় (শেখের শুভ উদয়)। আবদুর রহমান চিশতির মতে জালালউদ্দীন তাবরেজীর পুরো নাম ছিল আবুল কাশেম মখদুম শেখ জালাল তাবরেজী। তিনি শেখ শিহাবুদ্দীন সোহরওয়ার্দীর সাগরেদ ছিলেন। তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী, বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, নিযামুদ্দীন মুগরা ও দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিসের (১২১০-৩৬) সমসাময়িক। জন্মস্থান তাব্রিজ থেকে দিল্লী এলে তাকে সুলতান ইলতুৎমিস অভ্যর্থনা করেন। এ তথ্যে আস্থা রাখলে স্বীকার করতে হবে জালালউদ্দীন তাবরেজী লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলায় আসেননি। কেউ কেউ আবার শেখ জালালউদ্দীন তাবরেজী ও সিলেটের জালালউদ্দীন কুনিয়াঈকে অভিন্ন মনে করেন। শেখ জালালউদ্দীন বহুল আলোচিত সূফী।১৫ ময়মনসিংহ জেলার মদনপুরে শাহ সুলতান রুমী নামে এক সূফীর দরগাহ্ আছে। ইনি ৪৪৫ হিজরি বা ১০৫৩-৫৪ সনে ওখানে বিদ্যমান ছিলেন বলে পরবর্তীকালে দলিলসূত্রে দাবী করা হয়। এক কোচ রাজা তার হাতে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তাকে মদনপুর গ্রাম দান করেন বলে ময়মনসিংহ Gazetter-এ উল্লেখ আছে। কিন্তু আরো প্রায় সাড়ে তিনশ বছর পরে উক্ত জেলায় কোচ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব, উক্ত কোচ রাজা কোনো কোচ জমিদার হবেন, কিংবা সুলতান রুমী চৌদ্দ শতকের লোক।
পাবনা জেলার শাহজাদপুরে রয়েছে মুখদুম শাহ্ দৌলা শহীদের দরগাহ্। ইনি জালালউদ্দীন বোখারীর সমসাময়িক ছিলেন। অতএব ইনি বারো-তেরো শতকের লোক।
বর্ধমানের মঙ্গলকোট গায়ে মখদুম শাহ মাহমুদ গজনবী ওর্ষে শাহরাহী পীরের দরগাহ রয়েছে। ইনি স্থানীয় রাজা বিক্রম কেশরীর সাথে লড়েছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ্ সুলতান মাহি-আসোয়ারের স্বীকৃতি আওরঙজীবের সনদসূত্রেও (১০৯৬ হি. ১৬৮৫-৮৬) মিলে। তার সম্বন্ধে লোকশ্রুতি এই যে তিনি মুসলিম-বিদ্বেষী রাজা বলরাম ও পরশুরামকে হত্যা করেন। পরশুরামের ভগ্নী শিলাদেবী করতোয়া নদীর যেখানে ডুবে মরেছিল, তা এখনো শিলাদেবীর ঘাট নামে পরিচিত। ইনি সম্ভবত চৌদ্দশতকের লোক। মনে হয় মাহি-আসোয়ার (মৎস্যাকৃতি নৌকার আরোহী) খ্যাতির লোকেরা চৌদ্দশতকের পরের লোক নন। কেননা পনেরো শতকে আরব-ভারতের স্থলপথ জনপ্রিয় হয়। আর ষোলো শতকে পর্তুগীজেরা জলপথ নিয়ন্ত্রণ করত।
সিলেটের শাহ্ জালাউদ্দীন কুনিয়াঈ চৌদ্দশতকের দ্বিতীয় পাদে বাঙলাদেশে আসেন। ইবন বতুতা (১৩৩৮ সনে) সিলেটে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইনি রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
মখদুম-উল-মুলক শেখ শরফুদ্দীন ইয়াহীয়া ও তাঁর উস্তাদ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ সোনারগাঁয়ে (১২১০-৩৬, বা ১২৭০-৭১, কিংবা ১২৮২-৮৭ খ্রীস্টাব্দে) এসেছিলেন। ইনি এবং মকুল হোসেনে মুহম্মদ খান-বর্ণিত শেখ শরফুদ্দীন অভিন্ন ব্যক্তি কী না বলবার উপায় নেই।
শেখ বদিউদ্দীন শাহ মাদার সিরিয়া থেকে এসেছিলেন। এঁর পিতার নাম আবু ইসহাক শামী। ইনি মুসা নবীর ভাই হারুনের বংশধর। ইনিই সম্ভবত শূন্য পুরাণোক্ত নিরঞ্জনের রুম্মার দম মাদার। এবং মাদারীপুরও সম্ভবত তাঁর নাম বহন করছে। চট্টগ্রামের মাদারবাড়ী, মাদার শাহ্ এবং দরগাহ সংলগ্ন পুকুরের মাছের মাদারী নাম, শাহ্ মাদারের স্মরণার্থ বাঁশ তোলার বার্ষিক উৎসব প্রভৃতি মাদারিয়া সম্প্রদায়ের সূফীর বহুল প্রভাবের পরিচায়ক বলে ডক্টর এনামুল হক মনে করেন।
মখদুম জাহানিয়া জাহানগত ওফে জালালউদ্দীন সুপুশ (Surkpush) নামে এক দরবেশ বাঙলায় এসেছিলেন। জাহানসতের মৃত্যু হয় ১৩৮৩ খ্রীস্টাব্দে এবং উছে (Uchh) তার সমাধি আছে।
শেখ আখি সিরাজউদ্দীন উসমান নিযামুদ্দীন আউলিয়ার খলিফা ছিলেন। ইনি পাণ্ডুয়ার শেখ আলাউল হকের পীর। ইনি চৌদ্দ-পনেরো শতকের দরবেশ। তাঁর প্রভাবেই মুখ্যত বাঙলাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রসার হয়। পীরের নামানুসারে বিভিন্ন চিশতিয়া পীরের শিষ্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত হতেন। আলাউল হকের শিষ্যরা আলাহ, তাঁর পুত্র নূর কুতুব-ই-আলমের সাগরেদরা নূরী২৮ এবং আলাউলের খলিফা শেখ হোসেন ধুক্কারপোশ (Dhukkarposh)-এর সম্প্রদায়ের সূফীরা হোসেনী নামে পরিচিত ছিল। শেখ আলাউল হক ইসলামের উন্মেষযুগের মুসলিম সেনাপতি খালিদ-বিন-ওলীদের বংশধর। সেজন্যে তাঁর শিষ্যরা খালিদিয়া নামেও অভিহিত হতেন। আলাউল হকেরই পুত্র ছিলেন নূর কুতুব-ই-আলম। গণেশ-যদুর আমলে গৌড়ের রাজনীতিতে আলাউল হকের পরিবার স্মরণীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। নূর কুতুব-ই-আলমের পুত্র শেখ আনোয়ার রাজা গণেশ কর্তৃক সোনারগাঁয়ে নির্বাসিত ও পরে নিহত হন। নূর কুতুব-ই আলমের ভ্রাতুস্পুত্র শেখ জাহিদও সোনারগাঁয়ে নির্বাসিত হয়েছিলেন। জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ ওফেঁ যদু শেখ জাহিদের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন।