ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন, ডক্টর তমোনাশ দাসগুপ্ত, ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়, ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর আবদুর রহিম, ডক্টর মোমতাজুর রহমান তরফদার প্রমুখ রচিত সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থগুলো বাঙলা ও বাঙালির কালিক ইতিহাস। আর শ্রীঅজয় রায়ের বইটি সাধারণের জন্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। উপরোক্ত গ্রন্থগুলো পাঠে এই গ্রন্থে লব্ধ জ্ঞান পূর্ণতা পাবে। সুচির বাঙালির জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কিত এমনি আলোচনা গ্রন্থ আরো আরো কামনা করি। এমনি আত্ম পরিচিতিমূলক গ্রন্থে বাঙালির আজ বড় প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে পথিকৃৎ শ্রীঅজয় রায়কে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানেই বক্তব্যের শেষ করছি।
বাঙলায় সূফী প্রভাব
০১.
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে বাঙলাদেশে সূফী-দরবেশ এসেছিলেন কী না, ইতিহাস তা বলতে পারে না। তবু পাহাড়পুরে ও ময়নামতীতে আব্বাসীয় খলীফাদের মুদ্ৰাপ্রাপ্তি ও সোলেমান, খুরদাদবেহ, আলইদ্রিসী, আলমাসুদী প্রমুখ লেখকদের এবং দুদুল আলম গ্রন্থের বিবরণের প্রমাণে স্বীকার করতে হয় যে, অন্তত আটশতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। অবশ্য Periplus in the Erythrean Sea-র আলোকে যাচাই করলে এ সম্পর্ক খ্রীস্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেয়া সম্ভব।
চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বেনেরা বছরের কয়েক মাস থেকে যেত। সে-সূত্রে বন্দর এলাকায় তারা বৈবাহিক সম্পর্ক পাতিয়েছিল কি-না জানা নেই। তবে পরবর্তীকালের পর্তুগীজ প্রভৃতি য়ুরোপীয় বেনেদের জীবনযাপন রীতির কথা স্মরণ রাখলে, এ সম্পর্কও অনুমান করা চলে। ইংরেজ আমলে দেখেছি, বাঙালি মুসলমানেরা বার্মায় বর্মী স্ত্রী গ্রহণ করত আর তাদের সন্তানেরা জোরবাদী নামে পরিচিত হত। এমনি সঙ্কর মুসলমান হয়তো কিছুটা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায়। মুসলমান ব্যবসায়ীদের পাহাড়পুরে, ময়নামতীতে, কিংবা কামরূপে যাতায়াতও ছিল কি-না বলা যাবে না। কেননা, তাদের মুদ্রা ওসব অঞ্চলে অন্যভাবেও নীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু ইসলামের প্রচার ও প্রসার যুগে মুসলিম বেনে বা তাদের সঙ্গী কেউ ইসলামপ্রচারে আগ্রহী হয়নি এমন কথা ভাবব কেন? আমাদের মনে হয়, তখনো মুসলিম সমাজে সূফীমতবাদ প্রসার লাভ করেনি বলে এবং দণ্ডশক্তি বিধর্মীর হাতে ছিল বলে এদেশে যারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন বা অন্যসূত্রে এসে ইসলাম প্রচারের চেষ্টায় ছিলেন, তারা বিশেষ শ্রদ্ধা কিংবা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। দরবেশ না হলে তথা কেরামতির আভাস না পেলে অজ্ঞলোকেরা ভক্তি করবার কারণ খুঁজে পায় না। কাজেই তেমন লোকের স্মৃতি রক্ষার গরজও বোধ করে না। আর যদি মুসলিম বিজয়ের পূর্বে জালালউদ্দীন তাবরেজীর (?) মতো সূফীরা এসেও থাকেন তাহলেও মুসলিম-বিরল কিংবা বিহীন বিধর্মীর রাজ্যে তার স্মৃতিরক্ষার আয়োজন করবার লোকই ছিল না।
সূফীমত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে সূফীরা বিজিত ভারতেও আসতে শুরু করেন। তখন থেকেই খানকা ও দরগাকেন্দ্রী ইতিহাসেরও আরম্ভ।
কিন্তু চৌদ্দ শতকের এক সূফীর সাক্ষ্যে প্রমাণিত বাঙলাদেশে তার আগেই বহু সূফীর আগমন ঘটেছে। তারা বিভিন্ন মত-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শেখ আলাউল হক পাণ্ডুবীর সাগরেদ সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী কর্তৃক জৌনপুর সুলতান ইব্রাহীম শর্কীর নিকট লিখিত পত্রে আছে :
God be praised! What a good land is that Bengal where numerous saints and asceties came from many directions and made it their habitation and home. For example at Devgaon, followers of Hazrat Shaikh Shahabuddin Suhrwardi are taking their eternal rest. Several saints of the Suhrwardi order are lying burried in Mahisun and this is the case with saints of Jalalia order in Deotala. In Narkoti some of the best companions of the Shaikh Ahmed Damishqi are found. Hazrat Shaikh Sharfuddin Tawwama, one of the twelve of the Qadar Khani order whose chief pupil was Hazrat Shaikh Sharfuddin Maneri is lying burried at Sonargaon. And then there was Hazrat Badr Alam and Badr Alam Zahidi. In short, in the country of Bengal what to speak of the cities there is no town and no village where holy saints did not come and settle down. Many of the saints of the Suhrwardi order are dead and gone under earth but those still alive are also in fairly large number.
এতে বোঝা যায়, যে চৌদ্দ শতকের মধ্যেই বাঙলা দেশে সূফীপ্রভাব গভীরতা ও বিস্তৃতি লাভ করে।
কিন্তু যে কয়জন প্রাচীন সূফীর কাহিনী এবং খানকা ও দরগাহর খবর আমরা জানি, তাঁদের আগমন ও অবস্থিতি কাল সম্বন্ধে বিদ্বানেরা একমত নন। যেমন বাবা আদম শহীদ। বিক্রমপুরস্থিত রামপালের এই আদম শহীদ বিক্রমপুরের এক সেন রাজা বল্লালের সমসাময়িক। অনন্দভট্ট রচিত বল্লাল চরিতম সম্ভবত এঁরই জীবন চরিত লক্ষণসেনের পিতা প্রখ্যাত বল্লালসেনের নয়। বল্লাল চরিতোক্ত বায়াদুমবা সম্ভবত বাবা আদমেরই নামবিকৃতি। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে বল্লাল সেন চৌদ্দ শতকের শেষার্ধের লোক। কাজেই বাবা আদমও ঐ সময়ের।