এভাবে দেশজ লৌকিক ধর্মই কালে কালে বাঙালির জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাঙালির স্বাধীনতাপ্রীতি, স্বাজাত্যবোধ ও সঙ্-শক্তির সাক্ষ্য নগণ্য বটে, কিন্তু তার মাটি ও মর্ত্যপ্রীতি সর্বত্র সুপ্রকট। আদিতে তারও ছিল কৌম জীবন। বাহ্যত কর্মবিভাগ সে স্বীকার করেছে,সমাজে কর্মগত সহযোগিতা ও সংহতির গুরুত্বও কখনো অস্বীকৃত হয়নি। কিন্তু তার ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র-প্রবণতা ও আত্মরতি ছাপিয়ে উঠেছিল তার সহমর্মিতা ও সমধর্মিতার বন্ধনকে।
যখন সে জৈন-বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে তখনো কৌমচেতনা ছিল প্রবল এবং সম্ভবত বৌদ্ধ-মৌর্য শাসনেও তার বিচলন ঘটেনি। ব্রাহ্মণ্যগুপ্ত শাসনেই বৃত্তিগত বিভাগ বর্ণবিভাগে বিকৃত হয়। কেননা সে-সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীর সংখ্যা বাড়ে এবং বৌদ্ধ পাল আমলের প্রথম যুগে এ চেতনা ম্লান হলেও শেষের দিকে শঙ্করাচার্যের নব ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে এবং উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণাদি কর্মচারীর বাহুল্যে ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ সমাজ দ্রুত অপসৃত হয়ে বর্ণে বিন্যস্ত ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে উঠতে থাকে আর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন আমলে তা পূর্ণতা লাভ করে। এজন্যেই বাঙালির বর্ণবিন্যাস নিতান্ত কৃত্রিম। মোটামুটি ভাবে দশ থেকে ষোলো শতক অবধি মেল ও পটি বন্ধনের কাজ চলে। বল্লাল চরিত, দৈবকী-ধ্রুবানন্দ-পঞ্চানন ঘটক ও জাতিমালা কাছারি তার সাক্ষ্য। এমনি করে নিবর্ণ বৌদ্ধ সমাজ থকে বর্ণাশ্রিত হিন্দু সমাজ গড়ে উঠে। ফলে এখানকার হিন্দু-মুসলমান–কারো জাত-বর্ণ পরিচয় সন্দেহাতীতরূপে যথার্থ নয়। বিশেষ করে দ্রাবিড়-নিগ্রো-মোঙ্গল কারো মধ্যেই যখন বর্ণবিভাগ ছিল না, তখন এ যে আরোপিত ও অর্বাচীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাচীনকালে এখানে লোকসংখ্যা ছিল কম, গোত্রে বিভক্ত কৌমের নিবাস ছিল অঞ্চলে সীমিত। কাজেই জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দীক্ষার পরেই তারা গৌত্রিক গ্রাম থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। কিন্তু স্বাদেশিকতা নিতান্ত আধুনিক চেতনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভাষিক ঐক্যের ফলে তারা স্থানিক ঐক্য লাভ করেছিল বটে; কিন্তু দেশগত জীবন-চেতনা ছিল অনুপস্থিত। তাই বাঙালি হিন্দু ছিল উত্তর ভারতীয় আর্য-গৌরবে এবং রাজপুত-মারাঠার ঐতিহ্যগর্বে স্ফীত। আর মুসলমান– ছিল আরব-ইরানীর জ্ঞাতিত্ব মোহে ও গৌরবে অভিভূত। ইদানীং-পূর্ব যুগে কেউ সুস্থ ও স্বস্থ ছিল না। স্বদেশে প্রবাসী এই বাঙালির রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র চেতনার ও স্বাদেশিক কর্তব্যবুদ্ধির বিরলতার কারণ এই।
আজ ভেবে দেখবার সময় এসেছে : মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন-তুর্কী-মুঘল আমলে বাঙালি কী স্বাধীন ছিল– সুখী ছিল? স্বাধীন পাল কিংবা সুলতানী আমল কী বাঙালির স্বাধীনতার যুগ? বারোভূইয়ার বিদ্রোহ ও বীরত্ব কী স্বাধীনতাকামী বাঙালিরও সংগ্রাম ও ত্যাগের ঐতিহ্য? জাতীয়তার ভিত্তি হবে কী-গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, দেশ কিংবা রাষ্ট্র?
বাংলাদেশ ক্বচিৎ একচ্ছত্র শাসনে ছিল। তাই বাঙলা দেশান্তর্গত সব ঐতিহ্যে সর্ব বাঙালির অধিকার ছিল না। আঞ্চলিক মন, মনন ও সংস্কৃতির স্পষ্ট ছাপ আজো জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান। সাহিত্য ক্ষেত্রে এ আঞ্চলিকতা বিস্ময়করভাবে সুপ্রকট। যেমন ধর্মমঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল হয়েছে রাঢ় অঞ্চলে, মনসামঙ্গল হয়েছে পূর্ববঙ্গে, বৈষ্ণব সাহিত্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে; বাউল প্রভাব পড়েছে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে। সত্য-পীর বা সত্যনারায়ণ-কেন্দ্রী উপদেবতার প্রভাব-প্রসার ক্ষেত্র হচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ। গীতিকা হয়েছে ময়মনসিংহে-চট্টগ্রামে, মুসলিম রচিত সাহিত্যের বিশেষ বিকাশ ঘটেছে চট্টগ্রামে। গাঁজান, গম্ভীরা, বৈষ্ণবগীতি, বাউলগান, ভাবাইয়া, ভাটিয়ালী প্রভৃতিরও স্থানিক বিকাশ লক্ষণীয়।
দারু, কারু ও চারু শিল্পের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিকতা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকাই মসলিন ও শঙ্খশিল্প, সিলেটী গজদন্ত ও বেতশিল্প, নদীয়ার পাট-শিল্প, রাজশাহী-মালদাহ-মুর্শিদাবাদের রেশমশিল্প, পাবনা-টাঙ্গাইলের বস্ত্রশিল্প, চট্টগ্রামের নৌ ও দারু-শিল্প স্মতব্য।
বাঙালির লজ্জা ও গৌরবের কিছু ইঙ্গিত দিলাম। কিন্তু বাঙালি যেখানে স্বকীয় মহিমায় সমুন্নত, যেখানে সে অতুল্য এবং প্রাচ্যদেশে প্রায় অজেয়, তা বিদ্যা ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান। তার সাহিত্য ও তার দর্শন তার গৌরবের ও গর্বের এবং অপরের ঈর্ষার বস্তু।
আলোচ্য গ্রন্থে লেখক বাঙালির সুচির কালের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং তাঁর প্রয়াস অনেকাংশে সফল ও সার্থক হয়েছে বলেই মনে করি। আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিবৃত্ত আজো প্রায় অনুঘাটিতই রয়ে গেছে। কাজেই প্রমাণে-অনুমানে রচিত হয়েছে আমাদের ইতিহাসের ভিত। এই গ্রন্থের লেখক অদ্যাবধি আবিষ্কৃত ও অনুমিত তথ্য ও তত্ত্বের স্বাধীন প্রয়োগে রচনা করেছেন এ গ্রন্থ। এ গ্রন্থের মাধ্যমে উৎসুক ও জিজ্ঞাসু বাঙালির আত্মদর্শন হবে। এটি গ্রন্থকারেরও সম্ভবত লক্ষ্য। এ গ্রন্থের অনেক গুণ–ভাষা স্বচ্ছ ও সচল, ভঙ্গি প্রাঞ্জল, বক্তব্য সুস্পষ্ট। কিন্তু স্থানে স্থানে অসতর্কতার ছাপ রয়েছে, তথ্যের ভুলও কিছু আছে। সামান্যীকৃত (generalised) সিদ্ধান্তপ্রবণতা কম হলেই ভালো হত।