বৌদ্ধ ধর্মচক্র বা ধর্মকায় বজ্রযানে বজ্রকায়রূপে অভিহিত হয়। এই বজ্রকায় বজ্রসত্ত্বস্বরূপ এবং জ্ঞান ও করুণারূপ বুদ্ধ। এই আদি বুদ্ধের পঞ্চগুণ–রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। এদের নাম পঞ্চস্কন্ধ। এই পঞ্চস্কন্ধের প্রতীক দেবতা হচ্ছেন–বৈবোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, আমোঘসিদ্ধি ও অক্ষোভ্য। উক্ত সব স্কন্ধের ধ্যানের প্রয়োজনে সৃষ্ট বলে দেবতারা ধ্যানী বুদ্ধ বলে অভিহিত হন। এঁদের প্রকৃতি বা শক্তি হচ্ছেন যথাক্রমে তারা (বজ্রধাত্বেশ্বরী) মামকী, পাণ্ডরা, আর্যরা বা তারা ও লোচনা। এঁদের বোধিসত্ত্ব হচ্ছেন চক্রপাণি (সমন্তন্দ্র), রত্নপাণি, পদ্মপাণি (অবলোকিতেশ্বর), বিশ্বপাণি ও বজ্ৰপাণি। এরা ভূতপিশাচদেরও নাকি পূজা করত। যোনি প্রতীক যন্ত্রপূজাও করত।
দেবীদের মধ্যে আর্যরা–শ্যামাতারা, শেততারা, উগ্রতারা প্রভৃতি নানা নামে বিশেষ জনপ্রিয় হন। তাছাড়া হারিতা, মারীচি প্রভৃতি নামের প্রকৃতিও পরিকল্পিত হয়েছে। এই তারা পরে হিন্দু কালিকাতে রূপান্তরিত হয়েছেন। বৌদ্ধতন্ত্রে বজ্রসত্ত্ব হচ্ছে হেরুক বা হে বস্ত্র এবং তাঁর প্রকৃতির নাম হচ্ছে বজসত্ত্বাত্মিকা, বজ্রবরাহী, প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা পারমিতা প্রভৃতি আর তার আবাহনের বীজমন্ত্র হল হুং। শূন্যতা ও করুণাকে কমল (প্রজ্ঞা), বজ্র (পুরুষ), প্রজ্ঞা (নারী), উপায় (পুরুষ), চন্দ্র (নারী), সূর্য (পুরুষ), এবং পুরুষ ও প্রকৃতিরূপেও কল্পনা করা হয়েছে। এ দুটোর মিলনজনিত এক তুরীয় আনন্দময় অবস্থা বা চেতনার নাম বোধিচিত্ত। এইটিই তান্ত্রিকতত্ত্ব। শৈব-শাক্ত তন্ত্রের সঙ্গে এখানেই বৌদ্ধতন্ত্রের মৌলিক ঐক্য। বোধিচিত্তেই মহাসুখ, কমলকে (প্রজ্ঞা তথা নারী) বৌদ্ধতন্ত্রে (যোনির) এবং বজ্রকে (উপায় তথা পুরুষ) পুংলিঙ্গের প্রতীকরূপে ধরা হয়েছে! তাই বজ্ৰকমল সংযোগ অর্থ মৈথুনক্রিয়া। এই মৈথুনে যে সামরস্য তাই যুগনদ্ধ বা অদ্বয় এবং এই সামরস্যজাত আনন্দাবস্থাই বোধিচিত্ত। [এতদ অদ্বয়ং ইতি উক্তং বোধিচিত্তং ইদম পরম– সাধনমালা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭] অতএব প্রজ্ঞা-উপায় মৈথুনজাত মহাসুখরূপ বোধিচিত্ত লাভ করাই এ সাধনার লক্ষ্য। এ বজ্ৰতন্ত্রে হে বজ্র (বজ্রসত্ত্ব) নারী যোনিতে শুক্ররূপে বাস করেন বলে এবং শুক্র বিনা মহাসুখ লাভ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। বজ্রযানীরা চর্যাগীতির মতো বগীতিতে তাদের সাধনতত্ত্ব ব্যক্ত করত। উল্লেখ্য যে আদিকাল থেকেই গানের মাধ্যমে সাধন-ভজন রীতি চালু রয়েছে। সব ধর্মেই গান কৃচিৎ নাচ] সাধনা ও উপাসনার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অঙ্গ।
কালচক্রযান
বজ্রযানের সঙ্গে কালচক্রযানের মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। কালচক্রযানে কালচক্রই বজ্রসত্ত্ব। অর্থাৎ এখানে কাল-এর উপরই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা কাল ঘসতি ভূতানি। কালচক্র হচ্ছে–শূন্যতা ও করুণার তথা প্রজ্ঞা-উপায়ের অদ্বয়সত্তা। কালকে জয় বা অতিক্রম করে চিরন্তন বোধিচিত্ত লাভ তথা জন্ম ও মৃত্যু (উৎপত্তি ও ক্ষয়) নিরোধক শক্তিলাভই এ সাধনার লক্ষ্য। তাই কালচক্র বুদ্ধের জনকস্বরূপ এবং ত্রিকাল ও ত্রিকায়ের ধারক। (বিমলপ্রভা-বাংলার বাউল ও বাউল গান গ্রন্থের পাদটীকায় উদ্ধৃত। পৃষ্ঠা ২৩৪-৩৫)। সাধন সম্বন্ধে কালচক্রযানীরা দিন, তিথি, নক্ষত্র, যোগ প্রভৃতির বিচার করিতেন বলিয়া মনে হয়। অভয়াকর গুপ্ত কালচক্রাবতার গ্রন্থে বার তিথি-নক্ষত্র-যোগ-করণ-রাশি-ক্ষেত্রি-সংক্রান্তি প্রভৃতির বিশদ আলোচনা করেন। এ কথা সঙ্গতভাবেই অনুমান করা যায় যে, কালচক্রপন্থী সাধকেরা গ্রহ-নক্ষত্রের গতি অনুসারে তাহাদের সাধনজীবন নিয়ন্ত্রিত করিতে চেষ্টা করিতেন।৩৪ বৌদ্ধতন্ত্রে–বজ্র ও কালচক্রানে–তুকতাক্ উচাটন-বশীকরণ-মারণ প্রভৃতি ঐন্দ্রজালিক আচারাদি ছিল।
সহজযান
সহজযান দেব-দেবী, পূজা, মন্ত্র, প্রভৃতি সর্বপ্রকার আনুষ্ঠানিক ও আচারিক ধর্মের বিরোধী। কিন্তু বজ্রযানের সাধনপদ্ধতি ও সহজ যানের সাধনপদ্ধতি অভিন্ন। এমনকি বজ্রধর বা বজ্রসত্ত্বকে তারা মানে। সহজযানের প্রসারক্ষেত্র নেপাল ও তিব্বত। এ মার্গের শাস্ত্রগ্রন্থগুলোও তাই তিব্বতী ভাষায় অনূদিত ও রক্ষিত। আমাদের দোহাকোষ ও চর্যাপদগুলো সহজযানী সিদ্ধাদের রচিত। চর্যাপদে বামাচার ও প্রকৃতিবর্জিত সাধনার মিশ্রণ আছে। সহজযান মতেও প্রজ্ঞা-উপায়ের মিলনজনিত সামরস্য থেকেই মহাসুখরূপ সহজের উদ্ভব। এটিই বোধিচিত্ত। বৌদ্ধ চৌরাশী সিদ্ধার সবাই সহজিয়া ছিলেন না। তার প্রমাণ গোরক্ষ-মীননাথ কাহিনী–এঁরা প্রকৃতিবর্জিত পরম যোগী। কেউ কেউ সহজিয়া ছিলেন, তা চর্যাগীতিতে লক্ষণীয়।
সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও আচার প্রতিষ্ঠার জন্যে রাজকীয় প্রয়াস চলে। এ সময়েই কালবিবেক, দায়ভাগ প্রভৃতি স্মৃতিগ্রন্থাল্লেখিত ব্রাহ্মণ্য আচার সমাজে বহুল প্রচলিত হয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের শুরু হয় এভাবেই। চর্যাপদ থেকে এমনও অনুমান করা যায় যে, এ সমস্ত সহজযানীদের মধ্যে দ্বিবিধ সাধনপদ্ধতি চালু ছিল; একটি মৈথুনাত্মক তান্ত্রিকপদ্ধতি, অপরটি প্রকৃতিবর্জিত–বিশুদ্ধ যোগ-প্রণালী, হঠযোগের (চন্দ্র+সূর্য) মাধ্যমে দেহ বা কায়াসাধনই ছিল এঁদের লক্ষ্য।