বৌদ্ধতন্ত্র
প্রকৃতি ও পুরুষকে বৌদ্ধতন্ত্রে প্রজ্ঞা ও উপায় নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দুতন্ত্রের ঘটচক্র বা পদ্ম বৌদ্ধতন্ত্রে চারচক্র বা পদ্ম। এবং তা কায়রূপে পরিকল্পিত। প্রথম চক্রটি নাভির নিচে অবস্থিত। এর নাম নির্মাণকায়। দ্বিতীয় চক্ৰ হৃদয়দেশে অবস্থিত। এর নাম ধর্মকায়। তৃতীয় চক্র কণ্ঠদেশে। এর নাম সম্ভোগকায়। চতুর্থটি ব্রহ্মতালুতে অবস্থিত। এর নাম সহজকায়। এই সহজকায় বা উষ্ণীষ কমলকে মহাসুখচক্র বা মহামুখকমলও বলা হয়। হে বতন্ত্র অনুসারে জননেন্দ্রিয়ের স্থান হইতে চেতন-অচেতন সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হইয়াছে বলিয়া ঐ প্রদেশে নির্মাণকায় স্থাপিত হইয়াছে। ধর্মচক্র সমস্ত ধর্মের তত্ত্বরূপ বলিয়া হৃৎপ্রদেশে স্থাপিত, সম্ভোগ অর্থে ষড়রস সম্ভোগ, সম্ভোগকায় আনন্দ-রস সম্ভোগস্বরূপ, ইহা কণ্ঠদেশে স্থাপিত। মহাসুখচক্র তথা মহাসুখকায় মস্তকে স্থাপিত।
দেহস্থান — চক্র বা — কায় —- পদ্ম — মুদ্রা –– আনন্দ — দেবী — ক্ষণ
নাভি–নির্মাণচক্র–কায়–-নাভিপদ্ম চৌষট্টিদল–-কর্মমুদ্রা–-আনন্দকায়—লোচনা—বিচিত্র
হৃদয়—ধর্মচক্র–কায়–হৃৎপদ্ম বত্রিশ দল–ধর্মমুদ্রা–পরমানন্দ–মানকী–বিপাক
কণ্ঠ–সম্ভোগচক্র–কায়–কণ্ঠ পদ্ম ষোড়শ দল—মহামুদ্রা–বিরমানন্দ—পাত্র–বিমর্দ
মস্তক—সহজচক্র–উষ্ণীষ পদ্ম চতুর্দল—সময়মুদ্রা—সহজানন্দ—তারা– বিলক্ষণ
এদের সঙ্গে রয়েছে চার সাধনাঙ্গ–সেবা, উপসেবা, সাধনা ও মহাসাধনা।
চার আর্য সত্য– দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিবৃত্তি, নিবৃত্তির উপায়।
চার তত্ত্ব —আত্মতত্ত্ব, মন্ত্ৰতত্ত্ব, দেবতাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব।
এর সঙ্গে চার নিকায়, ঘোড়শ সংক্রান্তি, চৌষট্টি দণ্ড ও চার প্রহরাদির সম্পর্ক রয়েছে। আবার কোনো কোনো গ্রন্থে (যেমন সেকোদ্দেশ টীকা) কায়-বাক-চিত্ত-জ্ঞান অনুসারে প্রত্যেকের চার প্রকার ভেদ ধরে মোট ষোলো প্রকার আনন্দ নির্দেশ করা হয়েছে। বৌদ্ধতন্ত্রে ইড়া নাড়ির নাম ললনা, আলি, ধমন, চন্দ্র প্রভৃতি। পিঙ্গলার নাম রসনা, কালি, চমন, সূর্য প্রভৃতি। সুষুম্না নাড়ি, অবধূতী, দেবী, প্রজ্ঞা, নৈরাত্মা, যোগিনী, সহজ সুন্দরী প্রভৃতি নামে পরিচিত। বৌদ্ধতন্ত্রে ললনাকে প্রজ্ঞা (চন্দ্র) এবং রসনাকে উপায় (সূর্য) বলা হয়েছে। এ দুটো নাড়ির মিলন হয় অবধূতীতে। এ মিলন প্রজ্ঞা-উপায়ের মিলন। ললনা বিন্দু বহন করে, রসনা রজ: বহন করে, অবধূতী বহন করে প্রজ্ঞা-উপায় মিলনজনিত বোধিচিত্তকে। এই অবধূতীই সহজানন্দ স্বরূপিণী।
বৌদ্ধতন্ত্র সাধনায় হঠযোগের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা বিন্দুধারণ এবং তা ঊর্ধ্বে সঞ্চালনই এর লক্ষ্য। খড়গ, অঞ্জনা, পাদলেপা, অন্তর্ধান, রস রসায়ন, খেচর, ভূচর ও পাতাল বৌদ্ধতন্ত্রের এই অষ্টসিদ্ধি (সাধনমালা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫০)। নটী, রজকী, ডোমনী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণীই সাধন সঙ্গিনীরূপে বিশেষ উপযোগী। যোগিনী-ডাকিনীরা সিদ্ধিপ্রভাবে অলৌকিক শক্তিধর হয়।
মহাযান বৌদ্ধমত উদ্ভূত উপমত সমূহ
বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রের প্রচলন কবে থেকে হয়, তা সঠিক বলা যায় না। ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে বুদ্ধের সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিকতা প্রবেশ করে, বুদ্ধদেবই সাধারণ অশিক্ষিত লোকদের জন্য মুদ্রা, মন্ত্র প্রভৃতি প্রবর্তন করেন। মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাসই তান্ত্রিকতার ভিত্তি। বৌদ্ধগ্রন্থে মন্ত্রকে বলত ধারণী (যাহা দ্বারা কিছু ধারণ করা যায়)। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত বলেন, খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই বৌদ্ধতন্ত্রগুলো রচিত হতে থাকে। এ সময় বৌদ্ধ ক্ষান্তি-পারমিতা দান-পারমিতা প্রভৃতি তত্ত্ব দেবীরূপে কল্পিত হয়ে প্রমূর্তরূপে পূজা পেতে থাকেন। ধারণী বা বীজমন্ত্রও এ সময় থেকে রচিত হয়। অষ্ট সাহসিক প্রজ্ঞা পারমিতা > প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় সূত্র > প্রজ্ঞা পারমিতা ধারণী > প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্ররূপ সংক্ষেপকরণ পরম্পরায় অবশেষে প্রং এই বীজমন্ত্রে (তুলনীয় ওঁ) রূপ নিয়েছে। এই মন্ত্রনির্ভর পূজা-ধ্যান পদ্ধতির নাম মন্ত্রযান। সম্ভবত: এই মন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধের যোগাচার পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটে। আর প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব এর দার্শনিক ভিত্তি হয়। তার থেকেই ক্রমে বিভিন্ন মতের উদ্ভব হয়ে পাল আমলে তিনটি বিশিষ্ট উপমত হিসেবে বিকাশ লাভ করে। এ তিনটি হচ্ছে : বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান।
নাগার্জুনের মতে শূন্যতাই হচ্ছে নির্বাণ। এ মত পরে বসুবন্ধুরও সমর্থন পায়। তিনি বলেন, গ্রাহ্য-গ্রাহকের অস্তিত্বহীনতাই শূন্যতা আর এই শূন্যতাই নির্বাণ। অর্থাৎ বাহ্যত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে সব মায়ামাত্ৰভ্ৰমস্বরূপ–এটি অবিদ্যাজাত।
বজ্রযান
বজ্রযানে এই শূন্যতার নাম বজ্র। এটি অচ্ছেদ্য, অভেদ্য, অদাহী, অবিনাশী বজ্র। এই তত্ত্বই বজ্রসত্ত্ব–তার প্রমূর্তরূপ আদিবুদ্ধ। তিনিই পরমদেবতা। এই পরমদেবতা আত্মাও বটে, আবার সর্বজনীন পরমসত্তারূপে পরমাত্মাও বটে। এ বোধ মূলত ঔপনিষদিক এবং আস্তিক্যসূচক। এই বজ্রসত্ত্ব পরমব্রহ্মের মতো নির্গুণ, আবার সগুণও বটে। এই হচ্ছে বোধিচিত্ত বা শূন্যতা ও করুণা জ্ঞানরূপ সচ্চিদানন্দ স্বরূপ অবস্থা।