শীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা শহরে …
তথা যাই শিক্ষা লহ মাধববিবির সনে
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।
মাধববিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে, মহাযানের উপাস্য নরদেবতা অবলোকিতেশ্বর বাংলাদেশে লোকনাথ নাম নিয়ে বিষ্ণুর রূপান্তরে পরিণত হয়েছিলেন। …. বৌদ্ধযুগে বাংলাদেশে লোকনাথকে আশ্রয় করে ভক্তিধর্মের অঙ্কুর উদাত হয়েছিল। ….. বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে যেমন পূর্বেকার ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ভক্তিবাদের যুক্তবেণী প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তান্ত্রিক বৈষ্ণব অর্থাৎ বাউল সহজিয়া ইত্যাদি মতের মধ্যে তেমনি পূর্বযুগের শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতবাদের পরিণতি দেখা যায়। অষ্টম শতাব্দী কিংবা তারও পর থেকে বাংলাদেশে অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে তান্ত্রিকভাবের দুটি ধর্মমত চলিত ছিল–শৈবনাথমত এবং বৌদ্ধ সহজিয়ামত। এই দুই মতের সাধনায় ও দর্শনে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। নাথ সন্ন্যাসীরা নিজেদের যোগী বা কাঁপালিক বলত, এরা কানে নরাস্থি কুণ্ডল, কণ্ঠে নরাস্থি মালা, পায়ে নূপুর ও হাতে নরকপাল ধারণ করত এবং গায়ে ছাই মাখত। এদের আহার বিহার ছিল কদর্য, তাই গ্রামের বাহিরে ছিল এদের কুঁড়েঘর। যোগীদের নামের শেষে শব্দ হত নাথ। বর্তমান সময়ে যুগী জাতির (তাঁতি) মধ্যে নাথ পদবী ও পূর্বেকার আচার অনুষ্ঠান কিছু কিছু চলিত আছে। বৌদ্ধ সহজ সাধকেরা দেহতত্ত্বের সাধনা করত এবং আবশ্যক হলে যোগিনী বা অবধূতী অর্থাৎ সাধক-সঙ্গিনী গ্রহণ করত। এদের সাধনার সঙ্গে নিহিত আছে চর্যাপদে। ছকে ফেলে দেখলে বাঙলার তান্ত্রিক ধর্মের বিবর্তন এরূপ দাঁড়ায় :

তন্ত্রিক শৈব–শাক্ত ধর্ম
তন্ত্র হচ্ছে ভোগ-মোক্ষবাদ–ভোগের মাধ্যমে মোক্ষলাভই আদর্শ। নারীই জগত্তারণ আদ্যাশক্তি। তিনিই মহামায়া, কালী, তারা, শিবানী। নারীশক্তিতেই পুরুষ হয় শক্তিমান। শিব হচ্ছেন শক্তিমান। শিবশক্তি অদ্বয়ও বটে, ভিন্নও বটে। শক্তি সাধনায় শক্তিমান হওয়া তথা শিবত্ব উপলব্ধি করাই তান্ত্রিক সাধনার লক্ষ্য। এর সঙ্গে বৌদ্ধ বোধিচিত্ত বা মহাসুখ তুলনীয়। এ সাধনায় প্রকৃতিসঙ্গ প্রয়োজন। মৈথুনে বীর্যধারণের দরকার হয় না। রেতক্রিয়া অবিধেয় নয়। এ সাধনা করতে হয় নারীভাবে–বামা ভুত্বা যজেৎ পরাম। লতা, ভগবান-যন্ত্র, পদ্ম তথা নারীর যোনি-প্রতিম পূজার উপাদান। আসন, ন্যাস, মুদ্রা, মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র, বর্ণরেখাত্মক যন্ত্র, যোগক্রিয়া, দীক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি সাধনার অঙ্গ। এরা গুরুবাদী। সাধনাও গুহ্য। পঞ্চ মকারে তথা মাংস, মৎস্য, মদ্য, মুদ্রা ও মৈথুনে এরা বিশেষ আসক্ত। এরাও পরকীয়া বামা মৈথুনই প্রকৃষ্ট পন্থা বলে মানে। এদের গুরু চার প্রকার–গুরু, পরমগুরু, পরমেষ্টি গুরু ও পরাৎপর গুরু। তারা সবাই শিবের অংশ। হিন্দুতন্ত্রে মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে পর পর ছয়টি চক্র (ষটচক্র-মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র (দ্বিদল চক্র) ও তাদের সন্নিহিত পদ্ম, এবং ইড়া (গঙ্গা) পিঙ্গলা (যমুনা) সুষুম্না (সরস্বতী) প্রভৃতি বহু নাড়ির কল্পনা করা হয়েছে। সর্বনিম্নের চক্রের নাম মূলাধারচক্র। এতেই সৃষ্টিরূপা কুণ্ডলিনী সুষুপ্ত রয়েছে। ষট্চক্রের ঊর্ধ্বে রয়েছে সহস্রার (সহস্রদলপদ্ম), তাতে থাকেন পরম শিব। যৌগিক প্রক্রিয়ার দ্বারা এই কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে নিয়ে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে ত্রিগুণাতীত শিবত্ব উপলব্ধি হয়। এটি এক পরমানন্দময় অদ্বয়সত্তা–শিবশক্তির অদ্বয়সত্তা–এই মিলনজাত কেবলানন্দই সাধকের চরম আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। শিব পুরুষশক্তির প্রতীক–উমা নারীশক্তির প্রতীক–উভয়ের মিলনজনিত যে সামরস্য তাই কেবলানন্দ, বৌদ্ধ তান্ত্রিকের মহাসুখ ও বৈষ্ণব সহজিয়ার মহাভাবরূপ সহজাবস্থা। মূল পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বই হিন্দুর শিবশক্তি, বৌদ্ধের প্রজ্ঞা-উপায় এবং বৈষ্ণব ও বৈষ্ণব সহজিয়ার রাধাকৃষ্ণতত্ত্বে রূপ নিয়েছে।
শাক্তমন্ত্রে বামাচার ও দক্ষিণাগার নামে দুই সাধনপদ্ধতি আছে। বামাচার পঞ্চ ম-কার ভিত্তিক। আর দক্ষিণাগার ম-কার বর্জিত যোগনির্ভর।
ছকে হিন্দুতন্ত্র
চক্র ——- দেহস্থান ——- পদ্মদল অধিষ্ঠাত্র দেবতা
১. মূলাধার—– গুহ্যদেশ ও জননেন্দ্রিয়ের মধ্যস্থ ৪ —- ব্রহ্ম + ডাকিনী
২. স্বাধিষ্ঠান ——– জননেন্দ্রিয়ের মূলে সুষুমম্নর মধ্যস্থ চিত্রিনী নাড়ীস্থ ৬ — মহাবিষ্ণু + রাকিনী
৩. মণিপুর ——– নাভিমূলে ১০ ——– রুদ্র + লাকিনী
৪. অনাহত —— বক্ষ ১২ ——— ঈশ + কাকিনী
৫. বিশুদ্ধ ——- কণ্ঠ ১৬ ———— অর্ধনারীশ্বর (শিবশক্তি) + শাকিনী
৬. আজ্ঞা ——- ভ্রূ-দ্বয়ের মধ্যস্থ ২ —- পরশিব + হাকিনী
এর উপরে রয়েছে সহস্রদলপদ্ম, নাম সহস্রার। এটি পরমশিব ও কুণ্ডলিনীর মিলনস্থল। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না প্রভৃতি নাড়িই বায়ুপ্রবাহ পথ। ইচ্ছামতো বায়ু সঞ্চালনই যোগক্রিয়ার মূলভিত্তি। তাই নাড়ির সঙ্গে যোগের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। অবশ্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থে কিছু কিছু অনৈক্যও রয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতির তান্ত্রিক সাধনার মধ্যে দিব্যাচার, সমায়াচার, দক্ষিণাচার ও পশ্বাচার প্রভৃতি নামমাত্র তান্ত্রিক আচার। যথার্থ তান্ত্রিক আচার হচ্ছে : বীরাচার, বামাচার, চীনাচার ও কুলাচার। কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারই স্বীকৃত, নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় গ্রন্থ। বেশ্যা, নটী, রজকী, ব্রাহ্মণী প্রকৃতিই যোগ্য সাধন সঙ্গিনী।