.
০৪.
॥ তন্ত্র ॥
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্যের ধর্ম বা সংস্কার হিসেবে তন্ত্রের ব্যাপকতা দেখেই এক বিদ্বান বলেছেন:
In the popular knowledge and belief they have practically superseded the Vedas over a large part of India. In all writings (Tantric writings) these female principle is personified and made prominent to the almost total exclusion of the male.
তান্ত্রিক সাধনায় নারীর গুরুত্ব যে অত্যধিক তার সাক্ষ্য আচারভেদ তন্ত্রেও আছে :
পঞ্চতত্ত্বং খপুষ্পঞ্চ পূজয়েৎ কুলঘোষিতম্।
বামাচারো ভবত্ত এবামাভূত্বা যজেৎ পরাম ॥
শাক্তদের সাধনাও এরূপ। R. G. Bhandarkar বলেন :
The ambition of every pious follower of the system (sakta) is to become identical with Tripura-Sundari, and one of his religious exercises is to habituate himself to think that he is a woman.
সহজিয়াদের সাধনতত্ত্বও এরূপ। মনীন্দ্রমোহন বসু বলেন :
The sahajias also believe that at a certain stage of spiritual culture the man should transform himself into a woman and remember that he cannot have the experience of true love so long as he cannot realise the nature of woman in him.
এখানে বৈষ্ণবের রাধাভাব ও গোপীভাব স্মর্তব্য।
তন্ত্রমতে পুরুষ ও প্রকৃতির আদি মৈথুন থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি।৪ সাংখ্যেও তাই। বাচ্যবস্তুটিকে স্ত্রীরূপেই সাংখ্য কল্পনা করিয়াছে। প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে, যেমন নারী পুরুষকে বশ করে, প্রকৃতির ক্রিয়া ও নারীর লাস্য ও হাস্য এবং ভাবও ভাবের অনুরূপ কল্পিত হইয়াছে। চীনেও বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে এই ধারণাই ছিল। সৃষ্টি হচ্ছে Yang (পুরুষ) ও Yin (নারী) 49 cita avangal 2007 1 He (man) is described as a Microcasm-a world in miniature এ সব দেখে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে হয় যে ভারতের অনার্য সমাজে মিথুনতত্ত্ব, জাদু বিশ্বাস এবং মাতৃ বা ক্ষেত্র প্রাধান্য ছিল। ময়েনজোদাড়োর আবিক্রিয়া এবং দ্রাবিড় সমাজের নারীদেবতা প্রভৃতি এ বিশ্বাসের অনুকূল। দেবীপ্রসাদ বলেন, আমাদের যুক্তি অনুসারে, তন্ত্রের মতোই ওই সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলিও আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছে। পাঁচকড়ি বানার্জি বলেন–তন্ত্রের যে-কোনো পুথি পাঠ কর না কেন, তাহা পাঠ করিলে বুঝা যাইবে যে, অতি পুরাতন একটা শক্তি ধর্মের বুনিয়াদের উপর বৌদ্ধ মনীষা একটা নতুন ধর্মের প্রসাদ গড়িয়া তুলিয়াছেন। পরে নব্যহিন্দুর ব্রাহ্মণ-প্রতিভা বৌদ্ধের সেই মনীষা-প্রাসাদের উপর ব্রাহ্মণ্যের লেখা গাঢ় করিয়া লিখিয়া রাখিয়াছেন। তন্ত্রতত্ত্ব সম্বন্ধে পাঁচকড়ি বানার্জি বলেন, যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে–ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণা : সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে। ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত। ….. তন্ত্র বলিতেছেন যে যখন ব্রহ্মাণ্ড ও দেহভাণ্ড একই পদ্ধতি অনুসারে, একই রকমের উপাদান সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একই পদ্ধতির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্রহ্মাণ্ডের শক্তি তোমার অনুকূল হইবে। …. এদেশের সিদ্ধগণ বলেন যে মনুষ্যদেহের মতো পুর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই। …. অতএব এই যন্ত্রস্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে অন্য কোনো স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পূর্ণ হইতে পারে। এই উক্তির সমর্থন পাই ছান্দোগ্যে, বিরোচন বলেছেন, এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে, দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক–এই উভয়লোকই লাভ করা যায়।
শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, বাঙলাদেশে এবং তৎসলগ্ন পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চলসমূহে এই তন্ত্রপ্রভাব খ্রীস্টীয় অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধধর্মের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া মহাযান বৌদ্ধধর্মকে বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করিয়া দিয়াছিল। ….. বাঙলাদেশে যত হিন্দুতন্ত্র প্রচলিত আছে, তাহা মোটামুটিভাবে খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতক হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে রচিত। …. ভারতবর্ষের তন্ত্রসাধন মূলত: একটি সাধনা।…. এই তন্ত্রসাধনার একটি বিশেষ ধারা বৌদ্ধ দোহা কোষ এবং চর্যাগীতিগুলির ভিতর দিয়া যে সহজিয়ারূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্রমপরিণতি বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবং সপ্তদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ইহা এখানে একটা নবরূপ লাভ করিয়াছে এবং এই নবরূপেই বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে তাহা গভীর প্রভাবান্বিত করিয়াছে। এজন্যেই পাঁচকড়ি বানার্জি বলেছেন, সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরী ভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।
এই দেহতেই কৈলাস, এই দেহতেই হিমালয়, এই দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহতেই গোবর্ধন, এই দেহাভ্যন্তরেই হরগৌরী বা কৃষ্ণরাধিকা নানা লীলানাট্য প্রকাশ করিতেছেন। তাই তান্ত্রিক, যোগী, সহজিয়া বাউল সবাই দেহচর্যাকেই মূত্রত করেছে। আবার তান্ত্রিক ও সহজিয়ারা রতিপ্রয়োগে এবং নাথযোগীরা রতিনিরোধে এ সাধনা করে। যৌগিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এ সাধনা চলে, যোগ তাই বামাচারী ও বামাবর্জিত–এই দুই প্রকার। কামনিরোধ যোগাচার সম্বন্ধে শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন: