যাই হোক সেখানে একটা উন্নত সভ্যতা আছে। রাতের আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা তাদের শহরের আলো দেখতে পাই। ওখানে কয়েকটা ছোট কারখানা আছে। আছে উপকূলীয় যাতায়াত ব্যবস্থা। তবে কোন বড় জাহাজ নেই। আমরা কয়েকটা ছোট বিমানও দেখতে পেলাম পাঁচশ ক্লিকের গতিসীমার মধ্যে। যেটা তাদের যেকোন জায়গায় পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেয়।
অবশ্যই এরকম একটা ঘন সমাজে বিমানের খুব একটা দরকার নেই। আর তাদের বেশ ভালো রাস্তা আছে। এখনও আমরা কোন কমিউনিকেশন বের করতে পারিনি। আর কোন স্যাটেলাইটও নেই, এমনকি ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের জন্যও। হয়তো তাদের দরকার নেই, যেহেতু তাদের জাহাজগুলো কখনোই দৃষ্টিসীমার বাইরে যায় না। যাবার অবশ্য কোন জায়গাও নেই। অবশেষে আমরা এখানে এসেছি। এটা খুব আকর্ষণীয় অবস্থা আর বেশ চমৎকারও। অন্ততঃ আমি আশা করি। কোন প্রশ্ন? জ্বি, মি. লোরেনসন?
-স্যার আমরা কি যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেছি?
-এখনও না। আমাদের মনে হয় তাদের সংস্কৃতির মাত্রাটা না জেনে তাদের সঙ্গে কিছু করাটা ঠিক হবে না। যাই আমরা করি না কেন, সেটা তাদের জন্য বেশ বড় একটা ধাক্কা হবে।
-তারা কি জানে আমরা এখানে আছি?
-সম্ভবত না।
-কিন্তু আমাদের ড্রাইভ তো তাদের নিশ্চয়ই দেখার কথা।
-এটা অবশ্য একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। কোয়ান্টাম র্যামজেট পুরো শক্তিতে কাজ করলে সেটা হয় মানুষের শ্রেষ্ঠ দৃশ্যমান কৌশল। যা কিনা দেখা যাবেই। এটা আণবিক বোমার মতো উজ্জ্বল কিন্তু মিলিসেকেন্ডের বদলে এটাকে দেখা যায় মাস ধরে। তবে সন্দেহ আছে। আমাদের গর্জনের অধিকাংশটাই হয়েছে যখন আমরা সূর্যের অন্য পাশে ছিলাম। এর ঔজ্জ্বল্যে আমাদের দেখার কথা নয়।
এরপর সবাই যে কথাটা ভাবছে, সেটাই একজন জিজ্ঞেস করল।
–ক্যাপ্টেন, এটা আমাদের মিশনকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? সিরডার বে বক্তার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন
–এপর্যায়ে এটা বলা দুঃসাধ্য ব্যাপার। আরও কয়েকশ, হাজার মানুষ পুরো ব্যাপারটাকে অনেক সহজ করে দেয়। বা অন্ততঃ আরামদায়ক করে তোলে। কিন্তু যদি তারা আমাদের পছন্দ না করে…
তিনি শ্রাগ করলেন।
-এক পুরোনো অভিযাত্রীর একটা উপদেশ মনে পড়ছে। তুমি যদি স্থানীয়দের বন্ধু ভাব, তাহলে তারাও ভাববে। আর উল্টো ভাবলে উল্টোটা। যতক্ষণ অন্যকিছু প্রমাণিত না হচ্ছে আমরা তাদের বন্ধুবৎসই ভাবব। আর যদি তারা তা না হয়…
ক্যাপ্টেনের ভঙ্গীটা কঠোর হয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে গেল এক অধিনায়কের যে কিনা তার মহাকাশযানকে মাত্রই পঞ্চাশ আলোকবর্ষ পেরিয়ে নিয়ে এসেছেন।
-গায়ের জোরই ঠিক এটা আমি কখনোই বলিনি। তবে এটা থাকাটা বেশ স্বস্তির ব্যাপার।
৭. শেষের দিনের প্রভুরা
এটা সত্যি আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সে সত্যি সত্যি আবার জেগে উঠেছে এবং জীবনটাও আবার চলছে।
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লোরেন লোরেনসন জানত যে, সে কখনোই সেই ট্র্যাজেডীর হাত থেকে বের হতে পারবেনা, যা কিনা চল্লিশ প্রজন্ম ধরে ছায়ার মতো লেগে আছে এবং তার নিজস্ব জীবনেই তা চূড়ান্তে পৌঁছুবে। প্রথম কয়েকটা দিন সে একটু ভয়ে ছিল। এমনকি ম্যাগেলানের নীচের চমৎকার সামুদ্রিক গ্রহের কোন রহস্য, কোন আশাও তাকে ঐ চিন্তা থেকে বিরত রাখতে পারত না। দু’শ বছর পর স্বাভাবিক ঘুমে কি স্বপ্ন সে দেখবে?
সে এমন একটা দৃশ্যের স্বাক্ষী যা কিনা কেউ কোনদিন ভুলতে পারবে না। আর মানবজাতিকে তা শেষ সময় পর্যন্ত তাড়া করে ফিরবে। মহাকাশযানের টেলিস্কোপ দিয়ে সে দেখেছে সৌরজগতের মৃত্যু। নিজের চোখে সে দেখেছে মঙ্গলের আগ্নেয়গিরিগুলো লক্ষ বছর পরে প্রথম বারের মতো জেগে উঠল। আবহাওয়ামন্ডল উঠে যাওয়ায় ধ্বংস হবার ঠিক আগে শুক্র আবরণহীন হয়ে গেল। গ্যাসীয় দানবটা ভাস্বর হয়ে জ্বলতে লাগল। কিন্তু পৃথিবীর ট্র্যাজেডীর তুলনায় এগুলো কিছুই না। সেটাও অবশ্য সে ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়েই দেখেছিল। পৃথিবী কয়েক মিনিটের বেশী টেকেনি সেইসব মানুষদের চাইতে, যারা শেষ সময়গুলো উৎসর্গ করেছিল তাদের তৈরী করতে। সে দেখেছে…
বিশাল পিরামিডগুলো গলিত পাথরে পরিণত হবার আগে কি রকম লাল হয়ে উঠছিল…
আটলান্টিকের তলদেশ সেকেন্ডে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আবারও ডুবে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রের আগ্নেয়গিরিগুলোর লাভার স্রোতে…
ব্রাজিলের জ্বলন্ত অরণ্যের ওপর শেষ বারের মতো চাঁদ উঠেছিল সূর্যের মতোই উজ্জ্বল হয়ে…
দীর্ঘদিন ডুবে থাকার পর এ্যান্টার্টিকা জেগে উঠল, যখন প্রাচীন কিলোমিটার পুরু বরফ গলে গেল…
জিব্রাল্টার ব্রীজের মাঝের শক্তিশালী খিলান জ্বলন্ত বাতাসে উড়ে গেল…
শেষ শতাব্দীতে পৃথিবী ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ করল–মৃতদের নয় বরং যারা এখনও জন্মাতে পারে নি। পাঁচশ বছর ধরে জন্মহার এমনভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে, মানবজাতি কয়েক মিলিয়নে নেমে গেছে শেষের সে সময়ে। সব শহরগুলো এমনকি দেশগুলোও মরুভূমির মতো পরে রইল। কেননা মানবজাতি গাদাগাদি করে রইল একসঙ্গে ইতিহাসের শেষ ঘটনার জন্য।
এটা ছিল একটা অদ্ভুত বৈপরীত্যের সময়। হতাশা আর উন্মত্ত আনন্দের মধ্যে দোল খাওয়া। অনেকেই বিস্মৃতি পেতে চাইল প্রচলিত ড্রাগস, রমণ আর বিপদজনক খেলায়-স্বীকৃত অস্ত্র নিয়ে, সতর্কভাবে পরিচালিত ছোটখাট যুদ্ধ সেগুলো। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, অন্তহীন ভিডিও গেম, সক্রিয় স্বপ্ন, মস্তিষ্ককে সরাসরি উত্তেজিত করা ইত্যাদিও সমান জনপ্রিয় ছিল।