-তোমাদের বিশ্বাস করাটা হয়তো কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু আমরা তোমাদের কোন কলোনী থেকে আসিনি। আমরা সরাসরি পৃথিবী থেকে এসেছি।
০৬. ম্যাগেলান
ম্যাগেলান
৬. গ্রহ
লোরেন অবাক হল যে, চোখ খোলার আগেই কোথায় আছে সেটা সে ঠিক বুঝতে পেরেছে। দু’শ বছর নিদ্রার পর কিছুটা সন্দেহ থাকাটাই বরং স্বাভাবিক। কিন্তু মনে হচ্ছে মাত্র গতকাল সে মহাকাশযানের লগবুকে তার শেষ স্বাক্ষর করেছে। এবং যতদূর তার মনে পড়ে, একটা স্বপ্নও সে দেখেনি। এটা অবশ্য ধন্যবাদ পাবার মতো ব্যাপার।
চোখ বন্ধ করেই সে তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিল। নিশ্চিতভাবে সে মৃদু গুঞ্জন শুনছে। মুখের ওপর দিয়ে পরিচিতভাবে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, সুন্দর অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে মুখের চারপাশে।
কেবল ওজনের অনুভূতিটা পাওয়া যাচ্ছে না। সে অলসভাবে তার ডান হাতটা তুলল। সেটা বাতাসে ভাসতে লাগল পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
একটা ফুর্তিবাজ গলা শোনা গেল
-হ্যালো মি. লোরেনসন। দয়া করে তাহলে আপনি আবার আমাদের সঙ্গ দিচ্ছেন। কেমন লাগছে?
লোরেন অবশেষে চোখ খুলে তার বিছানার পাশে ভাসতে থাকা ঝাপসা অবয়বটাকে চিনতে চেষ্টা করল।
-হ্যালো-ডাক্তার। ভালো, আমি ক্ষুধার্ত।
-এটা সবসময়ই খুব ভালো লক্ষণ। তুমি পোশাক পর। খুব তাড়াহুড়ো কোরোনা। আর দাড়ি রাখবে কিনা সেটা নিয়ে পরেই ভেবো।
লোরেন ভেসে থাকা হাতটা তার মুখের দিকে নিয়ে এল। খোঁচা খোঁচা দাড়ির পরিমাণ দেখে সে অবাক হল। অধিকাংশ মানুষের মতোই সে চিরতরে দাড়ি উঠিয়ে ফেলায় রাজী হয়নি। অবশ্য সাইকোলজির একটা খন্ডই শুধু লেখা হয়েছে এ ব্যাপারটায়। তবে এখন মনে হয় ওটা করতে হবে। চিন্তা করো, এই তুচ্ছ ব্যাপারটা কি বিশৃংখলার সৃষ্টি করেছে।
-আমরা কি নিরাপদে পৌঁছেছি?
-অবশ্যই। নইলে তো তুমি ঘুমাতে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে। একমাস আগে থেকে মহাকাশযান আমাদের জাগাতে আরম্ভ করেছে আর এখন আমরা থ্যালসার কক্ষপথে। মেইনটেইনেন্স কু-রা সব চেক করেছে। এখন তোমাকে কিছু কাজ করতে হবে। এবং তোমার জন্য আমাদের একটা ছোট চমক আছে।
-নিশ্চয়ই ভালো কিছু।
-আমাদেরও তাই মনে হয়। মূল সভাকক্ষে দু’ঘন্টা পরে ক্যাপ্টেন বে একটা ব্রিফিং দেবেন। তুমি না যেতে চাইলে এখান থেকে দেখতে পার।
-আমি অবশ্যই যাব। সবার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রথমে কি আমি নাস্তাটা করে নিতে পারি। অনেক দিন তো হলো।
ক্যাপ্টেন সিরডার বেকে নতুন জাগানো পনেরোজনকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় কিছুটা ক্লান্ত হলেও আনন্দিত দেখাচ্ছিল। তিনি তাদের তিরিশজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যারা ক ও খ দলে ভাগ হয়ে কাজ করছে। মহাকাশযানের নিয়ম অনুযায়ী গ দলের ঘুমিয়েই থাকার কথা। তবে অনেকগুলো কারণ তাদের ওখানে থাকতে দেয়নি।
–আমি খুশি যে তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কিছু নতুন মুখ দেখতে ভালোই লাগে। আর এটাও আনন্দের যে আমাদের মহাকাশযান আমাদের প্রাথমিক দু’শ বছরের পরিকল্পনায় বড় কোন অসুবিধা না করেই এই গ্রহে এসে পৌঁছেছে। আমরা এখন থ্যালসায়। একদম ঠিক সময়ে। প্রত্যেকে দেয়ালজোড়া ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে ঘুরে তাকাল। এর অধিকাংশটাই বিভিন্ন উপাত্ত আর মহাকাশযানের বর্তমান অবস্থার তথ্য দিয়ে ভরা। কিন্তু সবচে বড় অংশটা মহাশূন্যের দিকে একটা জানালার মতো। এটা একটা চমৎকার নীল-সাদা গ্লোবের ছবি দিয়ে ভরা এবং সম্ভবতঃ প্রত্যেকেই গভীর বিষাদের সঙ্গে পৃথিবীর সঙ্গে মিলটা লক্ষ্য করল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর থেকে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনি, প্রায় পুরোটাই সমুদ্র আর ছোট ছোট কয়েকটা স্থলভাগ।
এখানকার ভূ-ভাগটা হচ্ছে তিনটা ঘনসন্নিবিষ্ট দ্বীপ-মেঘ দিয়ে কিছুটা ঢাকা। লোরেন হাওয়াই এর কথা চিন্তা করল, যাকে আর দেখা যাবে না। যার কোন অস্তি তৃই আর নেই। অবশ্য একটা মৌলিক পার্থক্য আছে দুই গ্রহের ভেতর। পৃথিবীর অনেকটাই জমি আর থ্যালসার প্রায় পুরোটাই সাগর।
ক্যাপ্টেন গর্বের সঙ্গে বললেন,–এটা এখানেই আছে। আমাদের মিশনের পরিকল্পনায় যা ধরা হয়েছিল। তবে একটা ব্যাপার হলো যে, তারা আমাদের আশা করেনি। অবশ্যই এটা আমাদের পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করবে।
আমরা জানি যে, থ্যালসা, মার্ক এক ৫০০০ ইউনিট মডেল দিয়ে কলোনীতে পরিণত হয়েছিল। যেটা ২৭৫১ সালে পৃথিবীকে ছেড়ে আসে এবং ৩১০৯ সালে অবতরণ করে। সবকিছু ভালোই চলছিল। একশ ষাট বছর পর আমরা প্রথম সঙ্কেত পাই। থেমে থেমে প্রায় দু’শ বছর ধরে তা চালু ছিল। তারপর হঠাৎই সেটা থেমে যায় একটা বিশাল অগ্নৎপাতের বড় খবর পাঠিয়ে। আর কিছুই শোনা যায় নি। আমরা ধরে নেই যে কলোনীটা ধ্বংস হয়ে গেছে বা এটা কোন পর্যায়ের আদিমতায় ফিরে গেছে–যেটা কিনা অন্যান্য কয়েক ক্ষেত্রে ঘটেছে।
নতুনদের সুবিধার জন্য আমরা এখন পর্যন্ত কি পেয়েছি তা আমি আবারও বলছি। স্বাভাবিকভাবেই সৌরজগৎটায় ঢোকার পর আমরা সব ফ্রিকোয়েন্সীতে শোনার চেষ্টা করেছি। কিছু না, এমনকি পাওয়ার সিস্টেমের অপচয়ের বিকিরণও আমরা পাইনি।
অবশ্য আরও কাছে গিয়ে বুঝলাম যে, সেটা কিছুই প্রমাণ করে না। থ্যালসায় আয়নোস্ফেয়ার অত্যন্ত ঘন। মিডিয়াম বা শর্ট ওয়েভে নীচে অনেক কথাই বলা যেতে পারে, বাইরে থেকে কেউই শুনবে না। মাইক্রোওয়েভ অবশ্য যেতে পারে। তবে হয়তো তাদের তা দরকার নেই, অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা কোন বীমই ধরতে পারিনি।