সেটা অবশ্য রোমাঞ্চের চেয়ে বেশী কিছু ছিল। তার ভাগ্য ভালো যে সে বেঁচে গিয়েছিল। হয়তো এখানেও বিপদ আছে, যদিও সে তা পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। রোবটরা কি আক্রমনাত্মক হতে পারে? বন্ধুত্ব আর জ্ঞান ছাড়া থ্যালসা থেকে বাইরের আর কেউ কি আশা করতে পারে? কাউন্সিলর সিমন্স বললেন,
-গাছের ওপারে যাবার আগে আমি ভালোভাবে ওটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত ওটা এক ধরনের বিমান। বীজ বহনকারী মহাকাশযানের কখনোই ডানা বা সরু ধোয়া বের হবে না। আর ওটা খুব ছোটও।
ব্র্যান্ট বলল,
যাই হোক না কেন আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানব। আলোটা দেখ, এটা ১. পৃথিবী উদ্যানে নেমে এসেছে। আমাদের কি গাড়ী বন্ধ করে হেঁটে যাওয়া ৬৩।
প্রথম অবতরণের পূর্বদিকে যত্ন করে উপবৃত্তাকার ঘাসের ‘পৃথিবী উদ্যান’ তৈরী করা হয়েছে। সেটা অবশ্য এখন গ্রহের সবচাইতে পুরোনো, পবিত্র মনুমেন্ট-পালক মহাকাশযানের কালো, লম্বা ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে। তার ওপর একটা সিলিন্ডারের ধার বেয়ে বয়ে যাচ্ছে আলোর বন্যা।
-জাহাজের কাছে পৌঁছাবার ঠিক আগে গাড়ী বন্ধ করবে, মেয়র নির্দেশ দিলেন। এরপর আমরা বের হব এবং উপরে উঠব। বাতিটা নেভাও। আমি চাইনা আমরা চাইবার আগেই তারা আমাদের দেখুক।
-তারা না ওটা?
একজন যাত্রী হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো বলল। সবাই অবশ্য তাকে অগ্রাহ্য করল। গাড়িটা মহাকাশযানের ছায়ার কাছে এসে থামল। আর ব্র্যান্ট এটাকে একশ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে রাখল। সে অবশ্য ব্যাখ্যা দিল।
-যদি দ্রুত ভাগতে হয় আরকি!
অর্ধেকটা গুরুত্ব আর অর্ধেকটা উত্যক্ত করার জন্য। সে এখনও বিশ্বাস করে না সত্যি সত্যি কোন আসল বিপদ হবে। এমনকি মাঝে মাঝে তার মনেই হচ্ছে না সত্যিই এটা ঘটছে।
সে হয়তো ঘুমিয়ে আছে আর এটা একটা দুঃস্বপ্ন।
তারা দ্রুত গাড়ী থেকে বের হয়ে মহাকাশযানে উঠল এবং আলোর পরিষ্কার দেয়ালটার কাছে গিয়ে ঘিরে দাঁড়াল। ব্র্যান্ট হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আধবোজা চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল।
কাউন্সিলর সিমন্স পুরোপুরি ঠিক। এটা কোনো ধরনের বিমান। আর খুব ছোট। উত্তরের লোকেরা কি? না অসম্ভব। এই ছোট তিন দ্বীপে এটা ব্যবহারের মতো কোন পথ নেই। আর এটা লুকিয়ে বানানোও সম্ভব নয়।
ভোতা তীরের মাথার মতো এটার গঠন। এবং নিশ্চিতভাবে এটা লম্বালম্বি ভাবে নেমেছে। কারণ আশে পাশের ঘাসে নামার কোন চিহ্ন নেই। সরু একটা কোন পেছনের জায়গা থেকেই তীব্র আলো ভেসে আসছে। আর ছোট্ট একটা লাল সঙ্কেত তার ঠিক ওপরে জ্বলে আছে। সব মিলিয়ে নিশ্চিত এবং হতাশাব্যঞ্জক একটা সাধারণ যন্ত্র। যেটা ডজনখানেক আলোকবর্ষ পেরিয়ে কাছের কলোনীতেই যেতে পারবে না। হঠাৎ করে দর্শনার্থীদের অন্ধ করে প্রধান আলোটা নিভে গেল। যখন। তারা রাতের দৃষ্টি ফিরে পেল তখন ব্র্যান্ট মেশিনটার সামনের জানালা দিয়ে ভেতরের জিনিস দেখতে পেল। এটা তো দেখতে মনুষ্য চালিত যন্ত্রের মতো, রোবট চালিত নয়।
মেয়রও এই বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন।
-এটা রোবট নয় এতে মানুষ আছে। আর সময় নষ্ট নয়। তোমার ফ্ল্যাশলাইটটা আমার ওপরে ধরো। যাতে তারা আমাকে দেখতে পায়।
চাঁদে প্রথম অবতরনকারী মানুষটা দুই হাজার বছর আগে ঠিক কি বলেছিল?
একটা ছোট পদক্ষেপ… তারা বিশ সেকেন্ডের মতো সময় নিল দরজা খোলার জন্য। তারপর দু’ভাঁজ করা একটা মই বেয়ে দু’জন মানুষ সদৃশ জীব নেমে এল।
সেটা অবশ্য ব্র্যান্টের প্রথম প্রতিক্রিয়া। তারপরই সে বুঝল যে তাদের গায়ের চামড়ার রঙ অথবা স্বচ্ছ, নমনীয় পুরো শরীর আবৃত করা আবরণ দেখে সে ভুল বুঝেছিল।
তারা মানুষ সদৃশ নয় তারা মানুষ। সে যদি আর কখনো রোদে না বের হয় সেও সম্ভবতঃ এদের মতো হবে।
মেয়র তার হাত দুটো “কোন অস্ত্র নেই” সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে বের করে রেখেছিলেন। সে বলল,
-আমি আশা করি না তোমরা বুঝবে। তবু বলছি থ্যালসায় স্বাগতম।
আগুন্তকরা হাসল। দুজনের মধ্যে বয়স্ক, ষাটের শেষের কোঠায়, ধূসর চুলের সুদর্শন ব্যক্তি তার হাত বাড়িয়ে দিলেন।
-ভুল হলো। তিনি বললেন। ব্র্যান্ট কখনো এতো গভীর অনুরণিত স্বর শোনেনি। আমরা তোমাদের পুরোপুরি বুঝতে পারছি। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা আনন্দিত।
এক মুহূর্তের জন্য অভ্যর্থনাকারীরা নিস্তব্ধ রইলো। ব্র্যান্ট অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটাকে ফালতু ভাবল। তাদের তো দু’হাজার বছর আগের মানুষের কথা বুঝতে সামান্য অসুবিধা হয় না। শব্দ যখন রেকর্ড করা গেল এটা সমস্ত ভাষার মূল ভাবটা জমিয়ে রাখল। শব্দভান্ডার বাড়ে, ব্যাকরণ বদলাতে পারে, কিন্তু উচ্চারণ হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত থাকে।
মেয়রই প্রথম ঘোর ভাংল। যে শান্তভাবেই বলল,
-তাহলে তো অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু তোমরা এসেছে কোত্থেকে? আমি আশংকা করছি, আমরা তোমাদের মানে আমাদের প্রতিবেশীদের যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের ডিপ স্পেস এ্যান্টেনাটা নষ্ট হয়ে গেছে।
বয়স্ক লোকটি তার লম্বা সঙ্গীর দিকে তাকালো এবং কোন নিঃশব্দ বার্তা তাদের মধ্যে বিনিময় হয়ে গেল। তারপর সে আবার অপেক্ষমান মেয়রের দিকে ফিরল। তার কণ্ঠের বিষণ্ণ ভাবটায় কোন ভুল নেই। এর পরেই সে উদ্ভট দাবীটা করল।