এখন রেডিও তারনা, চূড়ান্ত তবে অপ্রয়োজনীয় উৎক্ষেপনের সময় গণনা শুরু করেছে। ল্যাসানরা ঐতিহাসিক রেকর্ড ছাড়া এই কাউন্টডাউন কখনো শোনেনি। মিরিসা ভাবল, আমরা কি আদৌ কিছু দেখব? ম্যাগেলান গ্রহের অন্যপাশে মধ্য দুপুরের সাগরের বহু উপরে। আমাদের মাঝে পুরো গ্রহটা দাঁড়িয়ে… শূন্য… তারনা রেডিও ঘোষণা দিল এবং একটা গর্জনে ঢালা পড়ে গেল। ব্র্যান্ট ঝুঁকে পড়ল নৌকা সামলাতে। এবং আকাশ দীর্ণ হবার আগে রেডিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
পুরো দিগন্তে আগুনে ঝলসে উঠল। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই। এ এমন এক দৃশ্য যা ল্যাসানরা আগে কখনো দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখবে না।
এ এক চমৎকার শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। মিরিসা এখন বুঝতে পেরেছে কেন ম্যাগেলান গ্রহের উল্টোদিকে। যদিও এটা কোয়ান্টাম ড্রাইভ নয়, কেবল মাত্র এর সঙ্গে জ্বলতে থাকা প্রাথমিক ইঞ্জিনগুলোর শক্তি, যার পুরোটাই আয়োনোস্কিয়ার দিয়ে শশাষিত হবে। সুপারস্পেসের শকওয়েভ সম্বন্ধে একবার লোরেন বলেছিল যে, এমনকি এই ড্রাইভের স্রষ্টাও এর কারণটা ঠিক জানেন না।
কাঁকড়াগুলো এই মহাজাগতিক রশি দেখে কি করবে-মিরিসা ভাবল। গুল্মের নীচে ডুবন্ত শহরে কিছু আলো ফিল্টার হয়ে অবশ্যই পৌঁছুবে।
এটা কল্পনাও হতে পারে, তবে একটা বহুরঙা আলোর মুকুট তৈরী হচ্ছে আকাশ জুড়ে। সম্ভবত ম্যাগেলান গতি বাড়ানোর জন্য থ্যালসা ঘিরে একটা চক্কর দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ তার লাগল ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে এবং একই সময়ে সেটা কমে গেল। আর হঠাৎই সেটা থেমে গেল। রেডিও তারনা রুদ্ধশ্বাসে বাতাসে ভেসে এল।
…সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগুচ্ছে… মহাকাশযান দিক পরিবর্তন করছে… অন্যান্য জিনিস খুব ভালো বোঝা যাচ্ছে না… গ্রহের পাশে বাকী উত্তরণ ঘটবে, তবে তিনদিন পর যখন এটা এই গ্ৰহজগত ছেড়ে যাবে তখন আমরা একে দেখতে পাব সরাসরি…
মিরিসার কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আকাশে এখন আবার নক্ষত্র একটা দুটো করে ফুটে উঠছে- যে নক্ষত্রের দিকে তাকালেই এরপর থেকে তার লোরেনের কথা মনে পড়বে। যদিও এ মুহূর্তে তার। তেমন অনুভূতি নেই। যদিও বা চোখে থাকে জল– তা পরেই দেখা দেবে।
সে তার চারপাশে ব্র্যান্টের উষ্ণ হাত অনুভব করল আর মহাকাশের নিঃসঙ্গতার বিপরীতে তাদের এই নিবিড়তাকে সে স্বস্তিকর হিসেবেই গ্রহণ করল। এটাই তার জায়গা। আর কিছুর জন্য তার হৃদয় ব্যথিত হবে না। এবং এতোদিনে সে এটাও বুঝতে পারল যে, লোরেনকে সে পছন্দ করে তার শক্তির জন্য এবং ব্র্যান্টকে তার দুর্বলতার জন্য।
বিদায় লোরেন– সে ফিসফিসিয়ে বলল–তুমি আর তোমার সন্তান দূরের সে পৃথিবীতে সুখে থেকো। মানব সভ্যতার সেই নতুন সাম্রাজ্যে আমার কথা মনে কোরো, পৃথিবীর পথে তিনশ বছরের পরের কথা মনে কোরো তুমি।
ব্র্যান্ট তার চুলে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবল কোন সান্তনার কথা বলে। কিন্তু বুঝল যে নীরবতাই শ্রেয়। যদিও মিরিসা আবার তার হয়েছে, তবু কোন বিজয়ের অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করছে না। তাদের পুরানো, দায়িত্বহীন রোমান্স আজ মৃত। ব্র্যান্ট জানে লোরেনের ছায়া সব সময়ই তাদের সাথে অশরীরি ছায়া হয়ে থাকবে এবং তারা ছাই হয়ে বাতাসে মিশে যাবার দিনও সে থাকবে চির তরুণ।
তিনদিন পর যখন ম্যাগেলান পূব আকাশে দেখা দিল, খালি চোখে এর দিকে তাকানো যেত না। যদিও রেডিয়েশনের প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য এর কোয়ান্টাম ড্রাইভ অন্যদিকে সতর্কভাবে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছিল। সপ্তাহের পর সপ্তাহে, মাসের পর মাসে এটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল। যদিও কোথায় আছে জানা থাকলে দিনেও এটা দেখা যায় আর বছরের বেশী সময় ধরে এটা ছিল রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা।
দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে যাবার আগে মিরিসা শেষ বারের মতো এটা একবার দেখেছিল। এর কোয়ান্টাম ড্রাইভ-যা রেডিয়েশনের ভয় ছাড়াই সরাসরি থ্যালসার দিকে তাক করা, দূরত্বের কারণে মৃদুভাবে জ্বলছে।
যখন পনের আলোকবর্ষ দূরে, তখনও মিরিসার নাতি-নাতনিরা তৃতীয় উজ্জ্বলতার নীল তারাটাকে, বৈদ্যুতিক কাঁকড়া- প্রতিরক্ষা দেয়ালের পর্যবেক্ষণ চূড়ার ওপরে ঠিকই দেখতে পেত।
৫৬. সমুদ্রের তলদেশ
তারা এখনও বুদ্ধিমান না, তবে তাদের কৌতূহল আছে আর অন্তহীন যাত্রার পথে এটাই প্রথম পদক্ষেপ। প্রাচীন পৃথিবীর সমুদ্রের বহু প্রাণীর মতোই তারা হয়ত অন্ত হীনভাবে থাকতে পারত।
শেষের শতাব্দীর আগে অবশ্য তারা তেমন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেনি। কারণ বিশাল সেই গুল্মের জঙ্গল তাদের সব কিছুর যোগান দিত। বড় পাতাগুলো খাদ্য যোগাত, কান্ডগুলো দিত তাদের প্রাচীন প্রযুক্তির উপকরণ।
তাদের শুধু দুটো প্রাকৃতিক শত্রু ছিল। একটা হচ্ছে সব সময় খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কদাচিৎ দেখতে পাওয়া গভীর পানির মাছ। আর বিষাক্ত জেলী মাছ যা এক ধরনের ভেসে বেড়ানো পাল্প। মাঝে মাঝে তারা সমুদ্রের তলদেশে হামলে পড়ে পুরো জায়গাটা মরুভূমি বানিয়ে দেয়।
মাঝে মাঝে পানি আর হাওয়ার ঝাট ছাড়া কাঁকড়াগুলো হয়তো সারাজীবনই পানির তলে চমৎকার ভাবে অভিযোজিত হয়ে কাটিয়ে দিত। কিন্তু পিঁপড়ে বা উই পোকার মতো তারা বিবর্তনের কানা গলিতে ঢুকে পড়েনি। তারা পরিবর্তনের সাপেক্ষে সাড়া দিতে জানে।