তার গায়ের রং মিরিসা আগে কখনো দেখেনি। প্রগাঢ় কৃষ্ণবর্ণ যাতে নীলচে একটা ছাপ তা পৃথিবীতেও খুব কম ছিল। আরও কিছু শরীর সাদা ও হলুদ তার। চোখে পড়ল–এছবি, সে জানে, জীবনেও তার পিছু ছাড়বে না।
সে আবার তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। শত বছরের নিদ্রাও এর মুখে সংকল্প আর বুদ্ধিমত্তা মুছে দিতে পারেনি। আমরা কি পরস্পরের বন্ধু হতাম? মিরিসা ভাবল, মনে হয় না। আমরা বড় বেশী একরকম।
তাহলে তুমিই হলে কিতানি। তুমি নিয়ে যাচ্ছ লোরেনের প্রথম সন্তান নক্ষত্রের মাঝ দিয়ে। তবে সত্যিই কি সে প্রথম সন্তান হবে, যখন আমার সন্তানের শতাব্দী পর তার জন্ম হবে।
সে এখনও আবিষ্ট। শুধু ঠান্ডার কারণেই সেটা নয়। ক্রিস্টালের দরজা তাদের পিছনে বন্ধ হয়ে গেল। লোরেন তাকে অভিভাবকের পাশ দিয়ে ধরে নিয়ে গেল।
তার আঙ্গুলগুলো আরেকবার ছুঁয়ে গেল অমর সোনালী কিশোরের মুখ। উষ্ণতা মুহূর্তের জন্য তাকে চমকে দিল তারপরই তার মনে পড়ল তার শরীর এখনও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফেরেনি।
কয়েক মিনিট লাগল এতো কিছু দেখতে–মিরিসা ভাবল, কিন্তু তার বুকের ভেতর যে বরফ জমে আছে তা গলতে আর কতদিন লাগবে?
৫৪. বিদায় সম্ভাষণ
ইভলিন, দীর্ঘতম নিদ্রায় যাবার আগে এটাই তোমার সাথে শেষ কথা। আমি এখনও থ্যালসার মাটিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাটল এসে যাবে ম্যাগেলানের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য। আজ থেকে তিনশ বছর পরে গ্রহ বরণের আগে আমার আর কিছুই করার নেই… আমার বিষণ্ণ বোধ হচ্ছে। আমার প্রিয়তম বন্ধুকে আমি এইমাত্র বিদায় জানালাম, মিরিসা লিওনার্দ। তুমি যদি ওর সঙ্গে পরিচিত হতে পারতে। থ্যালসায় আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। আমরা কত কথা বলেছি যদিও আমার আশংকা তার অনেকটাই বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি যা নিয়ে তুমি প্রায়ই আমাকে খেপাতে…
সে প্রায়ই ঈশ্বর সংক্রান্ত প্রশ্ন করত। তবে তার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন যেটা ছিল তার উত্তর আমি ঠিকমতো দিতে পারিনি।
তার ছোট ভাইটি মারা যাবার পর, একদিন সে শুধালো, দুঃখের প্রয়োজন কি? এর কি কোন শারীরিক কাজ আছে?
কি আশ্চর্য আমি কখনো এই দিকে নজরই দেইনি। যদি কোন বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকে যাদের মৃতদের চিন্তা হয় কোন দুঃখ ছাড়াই, অথবা মৃতদের চিন্তাই তাদের মাথায় আসে না, তবে সেটা কেমন হবে। অবশ্যই মানবীয় না–তবে পৃথিবীর পিপড়া বা উইয়ের মতো তারাও বাঁচতে পারে।
বিষাদ কি ভালোবাসারই মতো দুর্ঘটনা অথবা অবশ্যম্ভাবী উপজাত? যার এক আবশ্যকীয় শারীরিক ক্রিয়া আছে। এ এক অদ্ভুত, কুহেলীময় চিন্তা। কিন্তু অনুভূতিই আমাদের মানুষ বানিয়েছে। কেইবা অনুভূতিগুলো বিসর্জন দিতে চাইবে, যদিও সে জানে যে প্রতিটি ভালোবাসাই আসলে সময় আর ভাগ্যের মতো দুই সহদরের হাতে জিম্মি মাত্র।
সে প্রায়ই আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করত ইভলিন। সে খুব বিভ্রান্ত হয়ে যেত, যখন সে ভাবত যে একজন পুরুষ কেবল সারাজীবন ধরে একজন নারীকে ভালোবাসতে পারে, আর তার মৃত্যুর পর অন্য কোন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তা করে না। আমি একবার তাকে খেলাচ্ছলে বলেছিলাম হিংসার মতো ব্যভিচার। শব্দটা ল্যাসানন্দের কাছে অপরিচিত। সে জবাব দিয়েছিল যে ওদুটো হারিয়ে তারা আদতে জিতে গেছে।
শাটল চলে এসেছে। তারা আমায় ডাকছে। থ্যালসাকে আমাকে এখন চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। আর তোমার স্মৃতিও ধূসর হয়ে আসছে। যদিও আমি সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াই, তবে আমি মনে হয় আমার দুঃখ বেশীই আঁকড়ে আছি, যা তোমার স্মৃতিকে ব্যাথাতুর করে তুলছে।
থ্যালসা আমাকে সুস্থির হতে সাহায্য করেছে। তোমাকে হারাবার বিলাপ না করে, তুমি একদিন আমার ছিলে এটাই এখন শান্তির।
এক অদ্ভুত সমাহিতভাব আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমার মনে হয় এই প্রথম আমি আমার বৌদ্ধ বন্ধুদের চিন্তা তাদের নির্বাণ কিছুটা বুঝতে পেরেছি… আর আমি যদি সাগান-২-এ জেগে নাও উঠি অসুবিধে নেই। আমার কাজ এখানেই সমাপ্ত হয়েছে –আমি তৃপ্ত।
৫৫. যাত্র
মাঝরাতের ঠিক আগে নৌকাটা গুল্মের জঙ্গলের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল। ব্র্যান্ট তিরিশ মিটার পানির গভীরে নোঙর করল। সকাল থেকে কাঁকড়া পল্লী হতে দক্ষিণ দ্বীপ পর্যন্ত সে গোয়েন্দা- গোলক ফেলতে ফেলতে এসেছে। ঠিকমতো কাজ করলে এ পথে কাঁকড়াদের আসা যাওয়া সব চোখে চোখে থাকবে। যদি উপহার ভেবে কোন কাঁকড়া এটাকে বাড়ী নিয়ে যায় তাহলে আরও ভালো। খোলা সাগরের চাইতে সেখান থেকে আরও ভালো তথ্য সেটা পাঠবে।
এখন আর কিছুই করার নেই। মৃদু দুলতে থাকা নৌকায় শুয়ে তারনার রেডিওতে ভেসে আসা মৃদু সঙ্গীত শোনা ছাড়া। আজকে সেটা অবশ্য কম। থেকে থেকে বসতির লোকেদের পক্ষ থেকে পাঠানো কোন শুভেচ্ছাবাণী অথবা কবিতা পড়ে শোনানো হচ্ছে। দুই দ্বীপের খুব কম লোকই আজ ঘুমাতে পারবে। মিরিসা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে সম্পূর্ণ অজানা একটা বিশ্বে অবশিষ্ট জীবনের জন্য নির্বাসিত হওয়া ইয়েন ফ্লেচার এবং তার সঙ্গীদের মনে কি চিন্তা খেলা করছে এই মুহূর্তে। উত্তরের এক ভিডিওতে সে তাদের শেষ দেখেছে। তাদের দেখতে মোটেও অসুখী মনে হয়নি। তারা এখানে ব্যবসার সুবিধা সম্বন্ধে আলোচনা করছিল।
ব্র্যান্ট এতো চুপচাপ যে, সে ভেবেছিল ব্র্যান্ট ঘুমিয়ে গিয়েছে। শুধু নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় আগের মতো শক্ত মুঠোর চাপটা বুঝিয়ে দেয় সে সজাগ। ব্র্যান্ট অনেক বদলেছে–সম্ভবতঃ তার চাইতেও বেশী। আগের অস্থিরতা নেই, বেড়েছে তার বিবেচনা বোধ। সবচে ভালো ব্যাপারটা হল ব্র্যান্ট বাচ্চাটাকে মেনে নিয়েছে। তার কথায় সে কেঁদে দিয়েছিল, ‘ওর দুটো বাবা হবে।’