লোরেন এবার তাকে আরও ভেতরে, ম্যাগেলানের অন্তরে নিয়ে গেল। এখনও তারা কোন মানুষের সাক্ষাৎ পায়নি। ম্যাগেলানের বিশালত্বের তুলনায় এটা কুর স্বল্পতাই প্রমাণ করে।
-আমরা প্রায় এসে গেছি। লোরেনের স্বর শ্রদ্ধায় নীচু। এই হচ্ছে অভিভাবক। অবাক হয়ে এগুতে গিয়ে মিরিসা প্রায় ভেসে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সোনালী মুখটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল একটু হলেই। হাত দিতেই সে ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল। এই প্রথম সে বুঝল এটা কোন ত্রিমাত্রিক ছবি নয়, আসল মূর্তি।
-এটা-ইনি-কে? মিরিসা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল।
-এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী শিল্পকর্মের একটি লোরেন মৃদু গর্বের সঙ্গে উত্তর দিল। এটা খুব বিখ্যাত। এ ছিল একজন রাজা, কিশোর অবস্থাতেই…
একটা সমান্তরাল চিন্তায় লোরেনের স্বর নেমে এল। মিরিসার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখের পাতা ফেলে পানি সরিয়ে সে সামনের লেখাগুলো পড়ল।
তুতেন খাম
১৩৬১-১৩৫৩ খ্রীষ্টপূর্ব
(সম্রাটের উপত্যকা ‘মিশর’ ১৯২২)
হ্যাঁ বয়সটা প্রায় কুমারের সমানই। সহস্রাব্দ পরে, সোনালী মুখ রাজার গর্ব নিয়েই তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে শক্তি এবং আস্থা থাকলেও নেই ঔদ্ধত্য।
-এখানে কেন? অনুমান একটা থাকলেও মিরিসা শুধালো।
-এটাকে একটা যথার্থ প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা ভাবত যে, ঠিকভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারলে মৃতরা কোন এক ধরনের পারলৌকিক জীবন শুরু করতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস সন্দেহ নেই কিন্তু একভাবে আমরা সেটাই সত্যি করেছি।
মিরিসা দুঃখের সঙ্গে ভাবল, আমি যেভাবে আশা করেছিলাম সেভাবে নয়। কিশোর রাজার চোখের দিকে তাকিয়ে, সোনার মুখোশের ওপর তাকিয়ে তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এটা কেবল একটা শিল্প, জীবন্ত কোন মানুষ নয়। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা শান্ত, সম্মোহক চোখ থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। আরেকবার সে হাত বাড়িয়ে সোনালী চিবুক স্পর্শ করল। প্রথম অবতরণের আর্কাইভে পাওয়া একটা কবিতা তার হঠাৎ মনে পড়ল। সান্তনা পাবার জন্য একটা কম্পিউটার সার্চে সে এটা পেয়েছিল। একশ’র বেশী বাক্যই খাপ খায় না, কিন্তু দুটো বাক্য ছিল একদম যথার্থ। (লেখক অজানা-? ১০০০-২১০০)
মানুষের গৌরবে তারা দিয়েছিল নতুন মাত্রা,
গর্বিত কিশোর, মৃত্যুতে আজ চিরযুবা।
মিরিসার চিন্তা সুস্থির না হওয়া পর্যন্ত লোরেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল। এরপর মুখোশের পাশে প্রায় অদৃশ্য ছেদায় কার্ড ঢোকাল। গোলাকার দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। মহাকাশযানের ভেতর ফারের পোশাক ভর্তি কক্ষ হজম করা শক্ত। কিন্তু মিরিসা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ইতিমধ্যেই তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নেমে গেছে। সে হি হি করে কাঁপতে শুরু করেছে।
শূন্য মাধ্যাকর্ষণের অসুবিধার জন্য লোরেন তাকে ফারের পোশাক পরতে সাহায্য করল। ছোট সে কক্ষের দেয়ালের মাঝে ছোট ঝাপসা কাঁচের দিকে তারা এগুলো। হঠাৎ করে ক্রিস্টালের একটি গুপ্তদরজা তাদের দিকে বেরিয়ে এল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এমন এক ঠান্ডা যার সঙ্গে মিরিসার কোন অভিজ্ঞতা নেই। বরফশীতল সেই ঠান্ডায় ভেসে থাকা কিছু কুয়াশা তাকে ঘিরে ধরল। সে এমনভাবে লোরেনের দিকে তাকাল যাতে বোঝাই যায় সে ঢুকতে চাচ্ছে না।
লোরেন তার হাত অভয় দেয়ার জন্য ধরল, ঘাবড়িও না–পোশাকটা তোমাকে রক্ষা করবে। আর কয়েক মিনিট পর তুমি টেরই পাবে না যে তোমার মুখে ঠান্ডা লাগছে। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না শোনালেও সত্যি। গুপ্ত দরজাটা পেরিয়ে প্রথম কৌতূহলী শ্বাস নিয়েই সে টের পেল ব্যাপারটা যতটা অপ্রীতিকর মনে হয়েছিল আদতে তা নয়। বরং তার ভালো লাগছে। সে এতো দিনে বুঝল কেন পৃথিবীর লোকেরা মেরু অঞ্চল ঘুরতে যেত।
সেই বিশাল বরফ রাজ্যের মধ্যে সে নিজেকে এখনই সহজেই কল্পনা করতে পারছে। চারপাশে বরফের এক বিশাল মৌচাক ঝকমক করছে। হাজারখানেক ষড়ভূজ দেখা যাচ্ছে। ম্যাগেলানের বরফ বর্মের যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ এটা শুধু পার্থক্য হল এগুলো মিটারখানেক চওড়া, আর একটার সঙ্গে আরেকটা নল আর তার দিয়ে যুক্ত। তাহলে এখানেই ঘুমিয়ে আছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ঔপনিবেশিকরা। যাদের কাছে পৃথিবী এখনো গতকালের স্মৃতি। দুশ বছরের যাত্রায় ঘুমিয়ে, কি স্বপ্ন দেখছে তারা? মৃত্যু আর জীবনের মাঝের সময়ে কি আদৌ মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখে? লোরেন ভাষ্যমতে দেখে না। কিন্তু তাই কি নিশ্চিত? মিরিসা ভিডিওতে মৌমাছির রহস্যময় অন্তহীন ব্যস্ততা দেখেছে। বিশাল এই মৌচাকের মাঝে লোরেনের হাত ধরে যেতে যেতে তার নিজেকে এক মানব-মৌমাছি মনে হচ্ছে। শূন্য অভিকর্ষে সে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঠান্ডাটাও সহনীয় হয়ে গেছে। তার নিজের শরীরের অনুভূতিই যেন হারিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে তাকে জোর করে মনে করতে হয় যে সে সত্যি জেগে আছে–ঘুমুচ্ছে না।
প্রতিটি প্রকোষ্ঠ কোন নাম নয় বরং নম্বর দিয়ে চিহ্নিত। লোরেন হ-৩৫৪-এ থামল। একটা বোম স্পর্শ করতেই একটা ষড়ভুজ আকৃতির কাঁচ আর ধাতু দিয়ে তৈরী টেলিস্কোপ আস্তে বেরিয়ে এল। চোখ দিতেই ভেতরে একজন নারী ঘুমিয়ে আছে দেখা যায়।
সে সুন্দরী নয় যদিও ঝাঁকড়া চুলের সৌন্দর্য না দেখেই এধরনের মন্তব্য ঠিক না।