লোরেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর উত্তর দিল- তুমি তো জান, ক্যাপ্টেন বে কোন অতিথি গ্রহণ করেন না।
মিরিসা জানে- কেন, তাও বোঝে। যদিও প্রথমে এটা বেশ কথা তুলেছিল। কিন্তু থ্যালসার সবাই এখন ব্যাপারটা বোঝে। ম্যাগেলানের অল্প সংখ্যক ক্রুদের মধ্যে অনেককেই ব্যস্ত থাকতে হবে ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে বা শূন্য-মধ্যাকর্ষণে যে পনের ভাগের মতো দর্শকদের বমি চলে আসে তাদের সেবায় লাগতে হবে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ফারাদীনকেও কৌশলে নিবৃত্ত করা হয়েছে।
–আমি মোজেসকে বলব। সে ক্যাপ্টেনকে বলবে। তাহলে হবে। কিন্তু মহাকাশযান চলে যাওয়া পর্যন্ত এটা যেন গোপন থাকে।
লোরেন তার দিকে তাকাল-হাসল। মিরিসা সব সময়ই তাকে অবাক করে, এটাই অবশ্য তার প্রতি আকর্ষণের মূল একটা কারণ এবং কিছুটা বিষাদের সঙ্গেই সে বুঝল মিরিসারই এই দাবী করা সাজে। তার ভাইই একমাত্র ল্যাসান যে ওপরে যেতে পেরেছিল। ক্যাপ্টেন বে বিবেচক মানুষ-প্রয়োজন অনুসারে তিনি নিয়ম পাল্টান। এবং মহাকাশযান চলে যাওয়ার পর আজ থেকে ঠিক তিনদিন পর-আর কিছু আসে যায় না।
–যদি তোমার সমুদ্র পীড়া থাকে?
–আমার কখনো হয়নি।
–সেটা কিছু প্রমাণ করে না।
-–আমি কমান্ডার নিউটনকে দেখিয়েছি। আমাকে তিনি পঁচানব্বই ভাগ মানসম্পন্ন বলেছেন। তিনি আমাকে মাঝরাতে শাটলে যেতে বলেছেন–তখন কোন লোক থাকে না আশেপাশে।
-তুমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছ–তাই না? লোরেন প্রশংসার সুরে বলল। দু’নম্বর ল্যান্ডিংয়ে মাঝরাতের পনের মিনিট আগে আমি দেখা করব। সে থামল। তারপর কষ্টে যোগ করল, আমি আর নামব না। ব্র্যান্টকে আমার হয়ে বিদায় জানিও।
এটা এমন একটা জিনিস যেটার মুখোমুখি সে হতে পারে না। কুমার মারা যাবার পর সে আর লিওনার্দের বাড়ীতে পা রাখেনি। ব্র্যান্ট আবার ফিরে এসেছে। যেন সে তাদের জীবনে কখনোই প্রবেশ করেনি।
সেও তাদের এড়িয়ে চলেছে। এখনও সে মিরিসার দিকে তাকায় ভালোবাসার দৃষ্টিতে, কিন্তু কামনা ছাড়াই। একটা গভীর বেদনা যা সে খুব কমই পেয়েছে–তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কতদিন সে ভেবেছে সে তার সন্তানকে দেখবে। কিন্তু ম্যাগেলানের নতুন সূচী তা অসম্ভব করে তুলেছে। যদিও সে তার সন্তানের হৃদস্পন্দন শুনেছে, কিন্তু সে কখনোই তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে পারবে না।
শাটলটা দিনের অংশে গেলে, মিরিসা প্রথম ম্যাগেলানকে দেখে প্রায় একশ কিলোমিটার দূর থেকে। মনে হয় সূর্যালোকে জ্বলা কোন খেলনা। দশ কিলোমিটার দূর থেকেও একে খুব বড় মনে হয়না। মধ্যের ওই গোল কালো জিনিসগুলো জানালা এমনটাই সে মনে করতে চাইছিল। শেষমেষ ঢোকার পর সে মেনে নিল যে ওগুলোই অবতরণের জায়গা।
লোরেন উদ্বিগ্নভাবে সীটবেল্ট খুলতে থাকা মিরিসার দিকে তাকিয়ে ছিল। এটাই হচ্ছে সবচে ভয়ঙ্কর সময়। সীটবেল্ট খোলা হঠাৎ মুক্তি পাওয়া অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী যাত্রী হঠাৎই প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে যে শূন্য-মাধ্যাকর্ষণ ততটা সুখপ্রদ জিনিস নয়। তবে বায়ুরোধী দরজা পেরিয়ে কয়েক ধাপ আসা মিরিসার মধ্যে কোন অস্বস্তি নেই।
ভাগ্য ভালো যে এক-মাধ্যাকর্ষণ স্থানে তোমার যেতে হবে না। দ্বিতীয়ত আবার ঠিক হওয়া ঝামেলা। মাটিতে না ফেরা পর্যন্ত মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।
এদের থাকার, খাবার জায়গাটা দেখতে পেলে ভালো হতো, মিরিসা ভাবল। কিন্তু সেখানে প্রচুর মোলায়েম কথা বলতে হবে অনেকের সঙ্গে। এখন যে জিনিসটা সে চাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন বে থ্যালসায় ভেবে তার ভালো লাগল–কোন সৌজন্য সাক্ষাতকারে যেতে হবে না।
তারা এয়ারলক ছেড়ে পুরো মহাকাশযানের সমান লম্বা এক করিডোরে পড়ল। এর একদিকে মই, আর অন্যদিকে হাত-পায়ের জন্য উপযোগী দু’সারিতে নমনীয় রশি–সেগুলো আপনা আপনি দুদিকে সরে যাচ্ছে।
–গতিবেগ বাড়ার সময় এটা খুব ভালো জায়গা নয়। লোরেন বলল। এটা তখন দু’কিলোমিটার লম্বা শ্যাফট হয়ে যায়। এসময় মই আর রশির গিটুগুলো লাগে।
তারা কয়েক’শ মিটার বিনা চেষ্টায় চলে গেল। তারপর ডানদিকের একটা করিডোরে ঢুকল। লোরেন বলল, রশিগুলো ছেড়ে দাও। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
মিরিসা রশি ছেড়ে দিয়ে করিডোরের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মোটা জানালা দিয়ে সে ভেতরের উজ্জ্বল, ধাতব জিনিসগুলোর দিকে তাকাল। সে যদিও পুরোটা বুঝল না, তবুও তার মনে হল বিশাল সিলিন্ডারগুলো পুরো মহাকাশযানকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
-কোয়ান্টাম ড্রাইভ। লোরেন গর্বের সঙ্গে বলল।
সেখানকার অসংখ্য ধাতব আর কৃষ্টালের যন্ত্রপাতি ব্যাখ্যার কোন চেষ্টাই সে অবশ্য করল না। প্রকোষ্ঠের ভেতর কৌতূহলোদ্দীপকভাবে উড়তে থাকা জিনিসগুলো, জ্বলতে নিভতে থাকা আলোগুলো, মিশমিশে কৃষ্ণতার মধ্যেই ফুটে ওঠা কোন অদ্ভুত আকৃতি, সবই কেমন রহস্যময়। কিছুক্ষণ পর সে বলল, মানব মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ আবিষ্কার। পৃথিবীর শেষ উপহার তার সন্তানদের প্রতি। একদিন এটাই আমাদেরকে নক্ষত্রের অধিপতি করবে।
কথাগুলোর মধ্যে এমন এক ঔদ্ধত্য ছিল যা মিরিসাকে মর্মাহত করল। এ যেন থ্যালসায় দ্রবীভূত হয়ে যাবার আগেকার লোরেন কথা বলছে। তাই অবশ্য হওয়া উচিত, মিরিসা ভাবল, তবে তারপরও তার কিছু অংশ সব সময়ের জন্যই পরিবর্তিত হয়েছে। সে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, তাহলেও কি নক্ষত্রের কিছু যাবে আসবে? তবে আসলেই সে মুগ্ধ হয়েছে। এসব বিশাল, অর্থহীন আকৃতির যন্ত্রগুলো তিরিশ আলোকবর্ষ পেরিয়ে লোরেনকে এখানে নিয়ে এসেছে তার কাছে। তবে সে নিশ্চিত নয় যা সে পেয়েছে তার জন্য কি একে শুভেচ্ছা জানাবে না যা নিয়ে যাচ্ছে তার জন্য অভিশাপ দেবে।