যতক্ষণ পর্যন্ত না থ্যালসার সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ, গ্রহের সবচেয়ে শক্তিশালী আমলাতন্ত্র নিঃশব্দে পুরো ব্যাপারটা ঠিক করুন ততক্ষণ পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটা ঝুলে রইল।
বিদায়ের সঙ্গীতকে হতে হবে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য মনে রাখার মতো কিছু একটা। কোন ভিডিও থাকবে না এর আবেদন অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য। শুধু বাজনা এবং নেপথ্য কণ্ঠ। দুই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে নিয়ে, ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হবে মূল বিষয়। যান্ত্রিক উৎকর্ষতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে কম্পোজাররা নতুন কি কম্পোজিশন বের করতে পারে তা আসলেই এক প্রশ্নের ব্যাপার। দুই হাজার বছর ধরে ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো মানব কানে পৌঁছায় এমন বাজনার প্রতিটি কমান্ড দিয়ে গেছে। ঐ মাধ্যমে আর নতুন কিছু আছে বলে মনে হয়না।
অবশ্য নতুন সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রে কম্পোজারদের অভ্যস্ত হতেই এক হাজার বছর লেগে গিয়েছিল। প্রযুক্তি আর কলার এই নতুন বন্ধনে বেটোফেন এবং বাখকে অতিক্রম না করলেও তাদের কাছে অনেকেই পৌঁছেছিলেন।
শ্রোতাদের কাছে এ ছিল নতুন জিনিস। পৃথিবীতে যা রেখে আসা হয়েছিল এ তার স্মৃতি। বিশাল ঘন্টার দূরাগত ধ্বনি পুরোনো মন্দিরের অদৃশ্য ধোঁয়ার মতো; শান্ত মাঝির সুর যা হারিয়ে গেছে চিরতরে; যুদ্ধে যাবার সৈনিকের গান- সময় যাদের সব দুঃখ কষ্ট চুরি করে নিয়ে গেছে; পৃথিবীর বড় শহরের দশ মিলিয়নের কণ্ঠস্বর; ঠান্ডা বরফের উপরে অরোরার অশরীরি নৃত্য; নক্ষত্র যাত্রার শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন। এই সব শব্দাবলী ভেসে এলো বিদায় সঙ্গীতে- সে সঙ্গীতে আছে দূর পৃথিবীর ডাক, আলোকবর্ষ পেরিয়ে যার আহ্বান…
শেষ অংশ হিসেবে প্রযোজক রেখেছিলেন শেষ শ্রেষ্ঠ সিম্ফনীকে। থ্যালসা যখন পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক হারায় সে বছরেরই সৃষ্টি। দর্শকদের কাছে এটা সম্পূর্ণ নতুন। এর সামুদ্রিক ভাবটা ছিল অনুষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ যুৎসই। এবং এর প্রভাব দর্শকদের ওপর যা ছিল তাই হতে পারে বহু আগে মৃত সুরকারের সর্বোচ্চ ইচ্ছা।
আমি যখন ‘আটলান্টিস শোকগাঁথা রচনা করি, তেমন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না। আমার কিছু অনুভূতি প্রবল ছিল, কোন সচেতনতা নয়। আমি চেয়েছিলাম সুরটা একটা বিষাদ, একটা রহস্য- একটা সব হারানোর ছায়া আনুক। মৎস্যে ঘেরা কোন শহরের ছবি আমি আঁকতে চাইনি। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে এখন যখনই আমি শেষটা শুনি, মনে হয় আমি এর জন্যই তৈরী…
যখন কিছু বাজনা নামতে নামতে অর্গানের একদম শেষ শব্দহীন জায়গায় নেমে গেল তারপর গভীর থেকে শব্দটা উঠতে লাগল, চড়া হতে শুরু করল…তুমি তো জানই যে সেই প্রাচীন, বিশাল তিমিদের সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে এটা রচনা করেছিলাম, যাদের আমরা বহু আগেই শেষ করে ফেলেছি নিষ্ঠুরভাবে। আমি এটা ওলগা কভ্রাসিনের জন্য লিখেছিলাম এবং তারপর আর কেউ ইলেকট্রনিক্সের সাহায্য না নিয়ে এটা গাইতে পারেনি।
কণ্ঠ সঙ্গীত যখন শুরু হয়, আমার মনে হয় সত্যি সত্যি কিছু একটা আছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেন্ট পিটার অথবা সেন্ট মার্কসের মতো বড় শহরের চতুরে। আমার চারপাশে আছে ভাঙ্গা, পুরনো গ্রীক মন্দিরের মতো বাড়ী, শুয়ে থাকা মূর্তি।
সমুদ্রের আগাছা আর গুল্মরা আমার চারপাশে দুলছে। আর সবকিছুই ঢাকা পড়ে আছে শ্যাওলায়।
চত্বরটা ফাঁকা থাকে প্রথমে, তারপর কিছু একটা নড়াচড়া করে। আমাকে জিজ্ঞেস করো না, কেন এটা সব সময়ই হঠাৎ আসে, কেন প্রতিবারেই মনে হয় আমি প্রথম দেখছি…
চত্বরের মাঝে একটা ঢিবি থেকে কয়েকটা দাগ বেরিয়ে গেছে। আমার মনে হয় যেন সেগুলি ধ্বসে পড়া দেয়াল, শ্যাওলায় ঢাকা। জিনিসটার কোন মাথা মুন্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না– তারপর হঠাৎ দেখি টিবিটা নড়ছে।
এক মুহূর্ত পর আমি দেখি বিশাল দুটো চোখ আমার দিকে নিস্পলক চেয়ে আছে। এইই সব–আর কিছু নয়। এখানে গত ছয় হাজার বছরে কিছু হয়নি। যখন থেকে সমুদ্র এই ভূমি গ্রাস করেছে এবং হারকিউলিসের প্রাচীর ডুবে গেছে। লেনেটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এতো দুঃখ আর নৈরাশ্যে আমার শেষ করতে ইচ্ছে করে না। তাই চূড়ান্ত ‘পুনরুত্থান’।
আমি জানি প্লেটোর আটলান্টিস কখনোই ছিল না। আর তাই এর মৃত্যুও নেই।
এটা একটা আদর্শ–একটা নিখুঁত স্বপ্ন সব মানুষকে উদ্দীপ্ত করার এক উৎস। তাই ভবিষ্যতের পদক্ষেপের স্বপ্নে সিম্ফনি শেষ হয়।
আমি জানি পদযাত্রার জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটা হচ্ছে মুদ্র হতে আটলান্টিসের নবযাত্রা। সেটা খুব বেশী গৎবাঁধা। আমার কাছে চূড়ান্ত যাত্রা হচ্ছে নক্ষত্রের পানে যাত্রা শুরু করার পর সমাপ্তি সঙ্গীত শেষ করতে আমার মাস খানেক সময় লেগেছে। এই পনেরোটা নোট আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। এখন শোকগাথা আমার কাছ থেকেই আলাদা হয়ে গেছে। এর নিজের একটা পথ হয়ে গেছে। এমনকি যখন পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যাবে তখনও টিসোলকোভস্কি গ্রহাণুতে বসানো পঞ্চাশ হাজার মেগাওয়াটের ডিপ স্পেস অ্যান্টেনা দিয়ে অ্যামিডা নক্ষত্রের দিকে সুর ভেসে যাবে।
একদিন, হাজার কোটি বছর পর এটা কেউ ধরবে, শুনবে এবং বুঝবে।
–কথার স্মৃতিঃ সের্গেই ডি পিটার (৩৪১১-৩৫০৯)
৫৩. সোনালী কিশোর
–আমরা এমন ভাব করি যেন ওটা নেই, মিরিসা অনুযোগ করল। কিন্তু আমি একবার ওটা দেখতে চাই।