এরপর দৃশ্য চলে গেল গ্রহের ছায়ায় ঘুরতে থাকা ম্যাগেলানে। তাৎক্ষণিক সচিত্র ভিডিওতে যে বিশাল সান-স্ক্রীনটা বরফটাকে ঢেকে রাখে, সেটা সরে গেলে পুরো বর্মটাকে প্রথমবারের মতো দেখা যায়।
ঠান্ডা সাদা বরফ পাতটা নিচের ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলসে উঠল। খুব শিগগিরি এটা চলে যাবে এমন মহাজাগতিক রাতে যেখানে তাপমাত্রা পরম শূন্যের মাত্র কয়েক ডিগ্রি ওপরে। সেখানে এটা কেবল উষ্ণ হবে নক্ষত্রের আলো, মহাকাশযানের রেডিয়েশন আর হঠাৎ করে আছড়ে পড়া কোন বস্তুর সংঘর্ষে।
ক্যামেরা ঘুরে বেরাতে লাগল বরফ বর্মের উপর তার সঙ্গে ভেসে এল সুপরিচিত মমাজেস ক্যালডরের ধ্বনি।
থ্যালসার অধিবাসীরা তোমাদের উপহারের জন্য ধন্যবাদ। আশা করি এই বরক বর্মের পেছনে সত্তর আলোকবর্ষ দূরে তিনশ র পাড়ি দিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছুবো। যদি সবকিছু ভালোভাবে চলে তাহলে সাগান-২তে আমরা পৌঁছাব অন্তত বিশ হাজার টন বরফ নিয়ে। এটাকে তখন ফেলা হবে গ্রহটার উপরে। এবং ঢোকার সময় সংঘর্ষে এটা গলে বন্ধ্যা সেই গ্রহে প্রথম বৃষ্টি ঘটাবে। জমে যাবার আগে সেটাই গ্রহের আদি সমুদ্র হবে। একদিন আমাদের উত্তরসূরীরা একটা সমুদ্র পাবে তোমাদের মতো যদিও তোমাদের মতো গভীর বা বিস্তৃত নয়। নতুন গ্রহে আমাদের দুই বিশ্বের জল মিলবে এক নতুন জীবনের স্পন্দনে। এবং আমরা তোমাদের মনে রাখব, ভালোবাসায় আর কৃতজ্ঞতায়।
৫১. পবিত্র
-কি সুন্দর! মিরিসা শ্রদ্ধা মিশ্রিত স্বরে বললো। এখন আমি বুঝতে পারলাম কেন পৃথিবীতে স্বর্ণ এতো মূল্যবান ছিল।
-সৰ্ণ ছিল খুব কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ক্যালডর ভেলভেটের বার থেকে দ্যুতিময় জিনিসটা বের করতে উত্তর দিল। তুমি কি বলতে পার এটা কি?
-নিশ্চয়ই এটা আরও বেশী কিছু?
-তুমি ঠিকই বলেছ। এটা একটা মহান সৌধ, একশ মিটারের উঁচু-তার প্রতিকৃতি। আদতে একটার ভেতরে আরেকটা নিয়ে মোট সাতটা অংশ ছিল। এটা ছিল সবচেয়ে ভেতরে পবিত্রতার শেষ চিহ্ন। আমার কিছু বন্ধু পৃথিবীর শেষ রাতে আমায় দিয়েছিল। তারা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চার হাজার বছর ধরে এটা পাহারা দিয়েছি। এটাকে নিয়ে যাও তারাদের দেশে। আমাদের আশীর্বাদ রইল।”
যদিও আমি তাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই কিন্তু এমন অমূল্য এক উপহার আমি কিভাবে অস্বীকার করি? এখন এটা এখানেই থাকুক। মানুষ যখন প্রথম এখানে এসেছিল তা ছিল পৃথিবীর প্রথম উপহার- এটা হোক শেষ।
-এভাবে বলল না, মিরিসা বলল। তোমরা এতো উপহার দিয়েছ–আমরা শুনে শেষ করতে পারব না।
লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে পরিচিত দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্যালডর কিছুক্ষণ কিছু বলল না। থ্যালসায় তার খুব ভালো সময় কেটেছে। থ্যালসার ইতিহাস পড়ে যা জেনেহে তা সাগান-২-এ নতুন উপনিবেশ করার জন্য অমূল্য সম্পদ হবে।
পুরানো মাতৃযান-বিদায়, সে ভাবল। তুমি তোমার কাজ ভালোই করেছ কি আমাদের তো আরও যেতে হবে বহুদূর। আশা করি তোমার মতোই ম্যাগেলান আমাদের বিশ্বাসী বন্ধু হবে। যেমন তুমি ছিলে এদের প্রতি।
-আমি নিশ্চিত যে, আমার বন্ধুরা আমার সঙ্গে একমত হবে, যে আমি ঠিকই করেছি। মহাকাশযানের চাইতে এখানকার পৃথিবীর যাদুঘরে এটা অনেক বেশী নিরাপদে থাকবে। এমনও তো হতে পারে যে আমরা সাগান-ত পৌঁছুতেই পারলাম না।
-অবশ্যই তোমরা পারবে। কিন্তু তুমি আমাকে বললে না তো যে ওই সাতটা বাক্সের মধ্যে কি থাকতো।
-এটা হচ্ছে একজন মহামানবের স্মৃতি চিহ্ন। তিনি এমন এক বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যা কোন রক্তে রঞ্জিত হয়নি। আমার মনে হয় সেও নলে অবাক হতো যে চল্লিশ হাজার বছর পর তার একটা দাঁত নক্ষত্রের পথে উড়ে গিয়েছে।
৫২. দূর পৃথিবীর ডাক
এখন যাত্রার সময়। সময় বিদায়ের। মৃত্যুর মতোই এই বিচ্ছেদ। থ্যালসা এবং ম্যাগেলানে যত অশ্রু ঝরে পড়ল, তার পেছনে একটা স্বস্তিও অবশ্য ছিল। যদিও ঠিক আগের মতো কখনোই ফেরা হয়না–তবুও জীবন আবার তার পুরোনো ছন্দ ফিরে পাবে। অভিযাত্রীরা ছিল যেন এমন এক অতিথি–যাদের থাকাটা একটু বেশী হয়ে গেছে গৃহস্বামীর বাড়িতে। এখন তাই যাবারই সময়।
এমনকি প্রেসিডেন্ট ফারাদীনও মেনে নিয়েছেন এবং তার আন্তঃগ্রহ অলিম্পিকের স্বপ্ন বাদ দিয়েছেন। তবুও তার যথেষ্ঠ তৃপ্তি আছে। ম্যানগ্রোভ বনের বরফ-কল উত্তর দ্বীপে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামী আসরের আগেই স্কেটিং রিং তৈরী হয়ে যাবে।
কোন প্রতিযোগী পাওয়া যাবে কিনা কে জানে–তবে অনেক তরুণ ন্যাসানই আগেকার খেলোয়াড়দের ভিডিও দেখতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে সবাই একমত যে ম্যাগেলানের যাত্রা উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান বা উচিত। কিন্তু সমস্যা হল কি করা উচিত তা নিয়ে কেউ একমত হতে পারছে না। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রচুর অনুষ্ঠান সবাইকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলেছে–কিন্তু কোন সরকারী উন্মুক্ত অনুষ্ঠান হয়নি। তারানার পক্ষ হতে মেয়র ওয়াডের্ন অনুষ্ঠানটি প্রথম অবতরণের জায়গায় করবার দাবী জানালেন। প্রেসিডেন্ট ফারদীন ছোট হলেও প্রেসিডেন্টের প্রাসাদই এর জন্য উপযুক্ত বলে যুক্তি দেখালেন। কেউ কেউ মধ্যবর্তী হিসাবে ক্র্যাকানের বিখ্যাত উপত্যকাকে চিহ্নিত করলেন।