কমান্ডার লোরেনসন-আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। ক্যাপ্টেন বেকেও ধন্যবাদ পৌঁছে দেবেন। কিন্তু আমরা এটা গ্রহণ করতে পারছি না। যাই হোক না কেন- কুমার চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। এমনকি যদি আপনারা সাফল্য পানও, যদিও তার নিশ্চয়তা নেই, সে জাগবে এক সম্পূর্ণ অচেনা জগতে। এবং সে জানবে, সে কোনদিনই আর তার প্রিয় ঘরে ফিরে যেতে পারবে না। তার প্রিয় জগত শতাব্দীরও বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। এটা সহ্যের বাইরে। আপনারা ভালোর জন্য বলছেন- কিন্তু সেটা তার জন্য ভালো হবেনা। আমরা তাকে তার প্রিয় সমুদ্রের কাছেই ফিরিয়ে দেব।
আর কিছু বলবার ছিল না। লোরেন একই সঙ্গে এক অন্তহীন বিষাদ এবং বিশাল মুক্তির অনুভূতি পেল।
সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। এবং এই সিদ্ধান্তটিই সে আশা করেছিল।
৪৯. সৈকতে বহ্নি
সেই ছোট্ট কায়াকটা কোনদিনই আর সম্পূর্ণ হবে না। তবুও সেটি তার প্রথম এবং শেষ অভিযানে যাচ্ছে।
সূর্যাস্তের সময় শান্ত সমুদ্রের পানির প্রান্তে এটা হয়েছিল। অপ্রত্যাশিত নয়, তবুও শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের দল দেখে লোরেনের শূন্য লাগছিল। পুরো তারানাই এখানে। পুরো দক্ষিণ দ্বীপ এমনকি উত্তর দ্বীপ থেকেও মানুষ এসেছে। এই অচিন্তনীয়, অস্বাভাবিক মৃত্যু সমগ্র গ্রহকেই বিষণ্ণ করেছে আর কৌতূহলে অনেকে আসলেও, লোরেন কখনও এরকম খাঁটি শোক দেখেনি। লোরেন কখনোই ভাবেনি ল্যাসানদের এতো গভীর অনুভূতি থাকতে পারে। সান্তনার আর্কাইভে মিরিসার খুঁজে পাওয়া একটা বাক্য তার স্মরন আসল ‘সমগ্র বিশ্বের ছোট্ট বন্ধু কে লিখেছিল জানা যায়নি, কেনই বা এটা এতোদিন সংরক্ষিত হল সেটাওনা।
অব্যক্ত সহানুভূতিতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া মিরিসার পরিবারকে সে মিরিসা এবং ব্র্যান্টের সঙ্গে ছেড়ে এল। দুই দ্বীপ থেকে তাদের প্রচুর আত্মীয় এসেছে। সে তাদের সঙ্গে থাকতে চাইছিল না। এই অপরিচিতরা কি ভাবছে সে জানে, সে তোমাকে একবার রক্ষা করেছে, কিন্তু তুমি পারনি। এই বোঝা তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
সবচেয়ে বড় মহাকাশযানের একজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তার জন্য বেমানান চোখের পানি লুকিয়ে রাখার জন্য সে ঠোঁট কামড়ে ধরল এবং অনুভব করল তার মনের একটা প্রতিরোধ শক্তি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। প্রচন্ড দুঃখের সময় এমন কিছু একটা আসে যা সাময়িক ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে হয়তো সেটা সম্পূর্ণই অন্য জিনিস অথবা হাস্যকর কোন স্মৃতি।
হা, মহাবিশ্বের বিচিত্র কৌতুক বোধ আছে। লোরেন জোর করে হাসিটা মুছে ফেলল। তার প্রতি শেষ কৌতুক করতে কুমারের কেমন লেগেছিল। অবাক হয়ে না, কমান্ডার নিউটন মর্গের দরজা খুলে শীতল ফরমালিনের গন্ধে ভরা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন। এটা প্রায়ই হয়। তোমরা যা ভাবো তার চাইতে বেশী। কখনও এটা হয় শেষ খিচুনী হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির শেষ চেষ্টা। এখানে সেটা হবে হয়তো বাইরের চাপ এবং শীতলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য।
বরফের ক্রিস্টালগুলো এই শরীর ধরে রেখেছে। লোরেনের মনে হলো কুমার আসলে ঘুমিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখছে।
মৃত্যুতে যেন ছোট্ট লিও আগের চাইতে আরও পুরুষালী হয়েছে।
পশ্চিমের নীচু পাহাড়গুলোর পেছনে সূর্য প্রায় লুকিয়ে পড়েছে। সাগর থেকে একটা শীতল বাতাস বয়ে এল। কায়াকটা পানিতে নেমে গেল। ব্র্যান্ট আর কুমারের তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেটা নিয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো লোরেন তার জীবনের জন্য ঋনী বাচ্চাটার মুখ দেখল।
এতক্ষণ ফেঁপানী শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু চারজন সাতারু যখন কায়াক নিয়ে তীর ছেড়ে সরে যেতে লাগল, সমবেত ভিড় থেকে বিলাপের শব্দ শোনা গেল। লোরেন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না– কে দেখল, তাতে তার কিছু আসে যায় না।
চারজন শক্তিশালী সারথীর হাতে কায়াকটা ধীরে ধীরে তীর থেকে সরে যেতে লাগল। দুটি বীকনবাতি যা খোলা সাগর নির্দেশ করে, তার মাঝ পর্যন্ত যেতে যেতে থ্যালসায় দ্রুত রাত নেমে এল। এর পরে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল ঢেউয়ের মাঝে।
শোক প্রকাশ থেমে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে। তারপরই হঠাৎ অন্ধকার আকাশ ভেদ করে একটা আলোকরশি সমুদ্রের বুক থেকে উঠে এল। এটা প্রায় ধোয়াহীন ভাবেই উজ্জ্বল ভাবে পুড়তে লাগল। কতক্ষন লোরেন জানে না-সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ আগুন নিভে গেল, সমুদ্রে ফিরে এল। এক মুহূর্তের জন্য সব আঁধার হয়ে গেল। আগুন আর সমুদ্র মিলতেই আকাশে কিছু স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরিত হল। কিছু সাগরে ফিরে এল, আর প্রায় সবই উড়ে গেল আকাশে।
এবং দ্বিতীয় বারের মতো কুমার লিওনার্দ তারার পানে যাত্রা করল।
৫০. দূর পৃথিবীর ডাক
দূর পৃথিবীর ডাক
৫০. বরফ বর্ম
শেষ বরফপাতটি ওঠানোর ব্যাপারটি হওয়া উচিৎ ছিল আনন্দময় ঘটনা। কিন্তু সেটা এখন বড়জোর একটা বিষণ্ণ সন্তুষ্টি। থ্যালসার তিরিশ হাজার মিটার ওপরে শেষ বরফপাতটি ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বরফ বর্মটি শেষ হলো।
দু’বছর পর এই প্রথম কোয়ান্টাম ড্রাইভ আবার ব্যবহার হলো, যদিও খুব অল্প শক্তিতে। ম্যাগেলান তার স্থির কক্ষপথ ছেড়ে গতি নিয়ে পরীক্ষা করলো বরফ বর্মের দৃঢ়তা এবং ভারসাম্য–যা তাকে নিয়ে যাবে নক্ষত্র রাজ্যের মাঝে। কাজটি ভালোই হয়েছে, কোন সমস্যা হলো না। এটা ছিল ক্যাপ্টেন বে’র জন্য একটা বিরাট স্বস্তি। কারণ তিনি কোনভাবেই এই কৃত্রিম হিমবাহের একজন অন্যতম স্থপতি ইয়েন ফ্লেচারের কথা ভুলতে পারছিলেন না। যাকে অবশ্য এখন উত্তর দ্বীপে আটকে রাখা হয়েছে এবং মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয় যে, এই সাফল্যের অনুষ্ঠান দেখতে ফ্লেচার এবং অন্যান্য স্যাব্রাদের কেমন লাগছে। অনুষ্ঠানে ছিল একটা ভিডিও রেট্রোস্পেকটিভ, যাতে প্রথম বরফ তৈরীর ঘটনা এবং প্রথম বরফপাত ওঠানোর দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। তারপর তাতে মহাকাশ ব্যালের সঙ্গে সঙ্গে দেখানো হলো বরফপাতগুলো কেমন করে উঠে গিয়ে বরফর্ম তৈরী করে। এখানে প্রথমে সত্যিকারের বিরতি এবং পরে প্রতি সেকেন্ডে প্রতিটি বরফপাত ওঠার দৃশ্য আসছিল। থ্যালসার প্রধান সুরকার এমনভাবে কম্পোজিশন করেছিলেন, যাতে প্রথমে খুব মৃদু লয়ে বাজনা শুরু হয়ে পরে দ্রুততায় পৌঁছে সবশেষে আবার ফিরে আসে প্রথম কোমল স্বরে।