এবং এরই মধ্যে সে এই জটিল ঐকতানের অন্যান্য উপাদানগুলো সম্বন্ধেও সচেতন হল। থেকে থেকে রিবনগুলোর সঙ্গে দৈত্যর মতো আংটাগুলো লাগার টুংটাং ধ্বনি ভেসে আসছিল। উল্কা? তা তো নয়ই। সম্ভবত থ্যালসার সামুদ্রিক আবহাওয়ার কোন বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গ? কিন্তু কুমার তখন নক্ষত্রের রাজ্য হারিয়ে গেছে। সুরময় রিবনে মাথা ঠেকিয়ে অর্ধেক মুখ খুলে সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে সেই অদ্ভুত সুরে। সে খেয়ালই করল না কখন ক্যারিনা রেগে এবং ভয় পেয়ে বরফ পেরিয়ে পরিচিত মৃত্তিকার উষ্ণতায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন কুমার নতুন একটা চড়া সুরের বাজনা শুনতে পাচ্ছে। এটা যেন তূর্য নিনাদ, যা কেবল কল্পনা করা যায়। সেটা এতো বিষণ্ণ আর দূরাগত। এটা কাছিয়ে আসছে, বাড়ছে- এ এমন এক রোমাঞ্চকর শব্দ যা কুমার কখনোই শোনেনি। এটা তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে স্থির করে রাখল। এবং এর পরই কুমার লিওনার্দ শেষ বারের মতো তার ঘুমন্ত বিশ্বের ভঙ্গুর সৌন্দর্যকে চোখ ভরে দেখল। দেখল তার সঙ্গের মেয়েটির ঊর্ধ্বমুখী, ভীত মুখখানি যে কিনা তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই ঘটনা স্পষ্ট মনে রেখেছিল।
তখন খুব দেরী হয়ে গেছে লাফাবার জন্যও। এবং তাই ছোট্ট লিওনার্দ উঠে গেল নির্বাক নক্ষত্রের মাঝে-নগ্ন এবং একা।
৪৮. সিদ্ধান্ত
ক্যাপ্টেনের মনে সমস্যাটা বিধে আছে। এবং একজন দূতের ওপর দায়িত্ব দিতে পেরে সে স্বস্তি পাচ্ছে। এবং কোন অবস্থাতেই লোরেন লোরেনসনের চাইতে উপযুক্ত এই ব্যাপারে আর কেউ নেই। সে যদিও কখনও তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়নি। এবং এখনও পরিচিত হওয়াটা সুখকর কিছু নয়। মিরিসা তার সঙ্গে যেতে চাইলেও সে রাজী হয়নি। ল্যাসানরা তাদের বৃদ্ধদের সম্মান করে এবং তাদের সুখস্বাচ্ছন্দের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে। লাল এবং নিকরি লিওনার্দ দক্ষিণ সৈকত ধারে ছোট্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ অবসর ভোগীদের জন্য বানানো কলোনীর একটায় বাস করে। তাদের ছয় রুমের বাসাটায় আছে শারীরিক পরিশ্রম কম লাগে এমন সব যন্ত্র। এমনকি সর্বক্ষণ রোবট সাহায্যকারী, যা লোরেন সারা দক্ষিণ দ্বীপে আগে দেখেনি। পৃথিবীর হিসেবে এদের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। প্রাথমিক সৌজন্য পরিচয়ের পর তারা বারান্দায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। রোবটটা পানীয় এবং ফল পরিবেশন করছিল। লোরেন জোর করে কিছু মুখে দিল। এবার সে সাহস সঞ্চয় করে তার জীবনের কঠিনতম কাজে হাত দিল।
–কুমার, নামটা তার গলায় আটকে গেল এবং তাকে আবার শুরু করতে হল। কুমার এখনও মহাকাশযানে। আমি আমার জীবনের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। সে আমাকে বাঁচাতে একবার তার জীবন বিপন্ন করেছিল। আপনারা হয়ত বুঝবেন তার। জন্য আমার কেমন লাগছে। আমি তার জন্য যে কোন কিছু করতে পারি।
আবার সে সময় নিল নিজেকে গুছিয়ে আনতে। তারপর সার্জন কমান্ডার নিউটনের মতো সে যথাসাধ্য দ্রুত এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল।
-তার শরীর প্রায় অক্ষতই। কারণ পচন শুরু হতে দেরী হয় আর দ্রুত সে জমে গিয়েছিল। কিন্তু সে শরীর তত্ত্বীয়ভাবে মৃত সপ্তাহখানেক আগে আমার মতোই।
কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। আমার শরীর মস্তিষ্কের ক্ষতি হবার আগেই উদ্ধার হয়েছিল। সুতরাং তাড়াতাড়ি আমি ফিরে এসেছিলাম।
কিন্তু কুমারকে উদ্ধার করতে ঘন্টা খানেক সময় লেগেছিল। গঠনে যদিও তার মস্তিষ্ক আগের মতোই আছে কিন্তু তাতে কোন স্পন্দন নেই। কিন্তু তার পরেও খুব উচ্চ প্রযুক্তিতে হয়তো একে ফেরানো যাবে। সারা পৃথিবীর রেকর্ড ঘেটে আমরা দেখেছি এরকম আগেও হয়েছে এবং সাফল্যের হার প্রায় ষাট ভাগ।
এবং এটা আমাদের দোটানায় ফেলে দিয়েছে। যেটা ব্যাখ্যা করতে ক্যাপ্টেন বে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। সঠিক ভাবে বলতে সেরকম অপারেশন করার মতো যন্ত্রপাতি এমুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। তবে তিনশ বছর পরে হয়ত…
আমাদের ঘুমন্ত কয়েকশ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের ভেতরে ডজনখানেক মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ আছেন। সেখানে আরও আছে টেকনিসিয়ান যারা যে কোন সার্জিকেল যন্ত্রপাতি তৈরী এবং চালাতে পারে। আমরা সাগান-২ এ পৌঁছুলেই পৃথিবীর সব কিছুই আবার ফিরে আসবে… তাদের চিন্তা করার জন্য সে বিরতি দিল।
আমরা চেষ্টা করব, বলা যায় খুশী হব কুমারের জন্য যতটুকু করা যায় তা করতে পারলে। আমরা যদিও কথা দিতে পারি না তবুও হয়তো সে একদিন বেঁচে উঠবে। আপনারা চিন্তা করুন।
সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আপনাদের প্রচুর সময় আছে। বৃদ্ধ দম্পতি দীর্ঘক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোরেন তাকাল সমুদ্রের দিকে। কি শান্ত সেটা। সে এখানে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে সুখী হতো, নাতি নাতনিরা মাঝে মাঝে আসত…
তারনার অনেক কিছুর মতো এটাও প্রায় পৃথিবীর মতোই। সম্ভবত ইচ্ছে করেই আশে পাশে কোন ল্যাসান উদ্ভিদ নেই, সবই বড় পরিচিত। কিন্তু কিছু একটা এখানে নেই, কিছু একটা যা তাকে বহুদিন ভাবিয়েছে, যখন থেকে এই গ্রহে পা দিয়েছে। এবং হঠাৎ তার স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। সে বুঝছে কি নেই এখানে। এখানে কোন গাংচিল নেই, নেই তাদের বিষণ্ণ ডাক।
লাল লিওনার্দ এবং তার স্ত্রী যদিও একটা শব্দও বিনিময় করেনি, তাও লোরেন লোরেনসন বুঝল কোন একভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।