–এস আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
–না।
–আমি বহুবার এখানে এসেছি। নিশ্চয়ই একা নয়, আমি নিশ্চিত ক্যারিনা ভাবল। কিন্তু কোন মন্তব্যের আগেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল কুমারের পাশে। কোমড় সমান পানি দুপুরের রোদে এখনও অস্বস্তিকর রকমের গরম। হাতে হাত ধরে তীরে উঠে শীতল বাতাসে দুজনের ভেজা শরীর জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল তারা যান্ত্রিক কোন বেহেস্তের আদম হাওয়া।
কুমার বলল, চিন্তা কোর না। আমি সবটা চিনি। ড. লোরেনসন আমাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন। কিন্তু আমি একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি, যা তিনি জানেন না।
তারা মাটি হতে মিটার খানেক উপরে থাকা বেশ ভালো আবরণী দেয়া একটি পাইপ ধরে চলছিল। এবং এই প্রথম ক্যারিনা পাইপের ভেতর ছুটে যাওয়া ঠান্ডা পানির শব্দ পেল। এখন তারা সেই চৌবাচ্চার সামনে, যেখানে বিখ্যাত কাঁকড়াটাকে পাওয়া গিয়েছিল। খুব অল্প পানিই দেখা যাচ্ছে। উপরটা গুল্ম দিয়ে প্রায় পুরোটা ভর্তি। যদিও থ্যালসায় কোন সরীসৃপ নেই, তারপরও গুল্মের মোটা কান্ড ক্যারিনাকে সাপের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
তারা অনেকগুলো কালভার্ট এবং ছোট সুইজ গেইট পার হল। তারপর মূল প্ল্যান্টের বাইরে একটা বড়, খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। তারা মূল কাঠামো ছেড়ে যাবার সময় কুমার একটা ক্যামেরার লেন্সের দিকে ভেংচি কাটল। কেউই বলতে পারেনি কেন এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যামেরাটা বন্ধ ছিল। বরফের পাত, কুমার বলল। প্রত্যেকটার ওজন ছয়শ টন। পঁচানব্বই ভাগ পানি আর পাঁচ ভাগ গুল্ম। হাসির কি দেখলে?
-হাসির নয় তবে অদ্ভুত, তখনও ক্যারিনা হাসছে। চিন্তা করো তারা আমাদের সামুদ্রিক জঙ্গলের একটা অংশ তারার রাজ্যের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেটার জন্য নিশ্চয়ই তুমি আমাকে আননি।
-না, আস্তে করে কুমার বলল। দেখ…
সে কি দেখাতে চাইলো ক্যারিনা প্রথম বুঝতেই পারলনা। তারপর একদম দৃষ্টিসীমার প্রান্তে এক জ্বলজ্বলে ছায়া দেখতে পেল। তখন সে বুঝল।
এটা অবশ্য সেই পুরানো ম্যাজিক। মানুষ হাজার বছর ধরে বহু জায়গায় এটা করেছে কিন্তু নিজের চোখে তা দেখার ব্যাপারটা সত্যিই অবিস্মরণীয়।.
এবার তারা শেষ ট্যাংক পর্যন্ত হেঁটে গেল, যাতে ভালোভাবে দেখা যায়। সূক্ষ্ম আলোর সুতো কয়েক সেন্টিমিটারের চেয়ে মোটা নয়, সোজা উঠে গেছে তারাদের দিকে আলোর বীমের মতো। ক্যারিনা যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, দেখল। কোথায় যে এটা হারিয়ে যায় বোঝা মুস্কিল। তারপর সে নিজেই খুঁজে বের করল। অনেক উপরে একটা ছোট্ট স্থির তারা। অন্য প্রাকাক সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। একটা নাক্ষত্রিক মাকড়সার মতো ম্যাগেলান তার সুতো ছাড়ছে নীচের পৃথিবীর উপহারের জন্য। এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষারত বরফ চাকের একদম প্রান্তে। এখানে আরেকটা বিস্ময় ছিল। এর উপরটা, চকচকে হলুদ ফয়েলে যেন মোড়ানো বাচ্চাদের জন্মদিনের উপহার বাবা-মা যেমন মুড়িয়ে দেয়।
-বর্ম, কুমার বোঝালো। এটা সত্যিকারের সোনা, প্রায় দুই অনু পুরু। এটা না থাকলে ওঠানোর আগেই অর্ধেক বরফ গলে যেত।
বর্ম আছে কি নেই তা বোঝা না গেলেও ক্যারিনা তার পায়ের নীচে বরফের ঠান্ডা কামড় টের পাচ্ছিল। ডজন খানেক পা চালাতেই তারা একদম মাঝখানে চলে গেল সেখানে ত্রিশ হাজার ওপরের আকর্ষণে টানটান হয়ে থাকা অধাতব রিবনগুলো একত্রে বরফ ওপরে নিয়ে যায়। রিবনগুলো শেষ হয়েছে এক ড্রামে। যার যন্ত্রপাতি এবং জেটগুলো বুঝিয়ে দেয় যে এটা সচল বুদ্ধিমান ক্রেন, যা ওপর আসা রশিকে লক্ষ্যভেদে সাহায্য করে। পুরো জিনিসটাই একটা উন্নত পরিণত প্রযুক্তির সরলতা প্রকাশ করে।
ক্যারিনা হঠাৎ কেঁপে উঠল। শীতের জন্য নয়, সেটা এখন টেরই পাওয়া যাচ্ছে না।
-তুমি কি নিশ্চিত কোন বিপদ নেই, সে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধাল।
-অবশ্যই। তারা সব সময় মাঝরাতে তোলে। সেটা এখনও আধঘন্টা দেরী। সেটা দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু এতোক্ষণ বোধহয় থাকা যাবেনা।
এবার কুমার বসে পড়ল। হাটু মুড়ে গ্রহ আর মহাকাশযানের মধ্যের সংযোগকারী রিবনগুলোর ওপর কান পাতল। যদি এটা উঠে যায়, তাহলে কি তারাও উড়ে যাবে, ক্যারিনা ভাবল?
–শোন, কুমার ফিসফিসিয়ে বলল।
ক্যারিনার জানা ছিল না কি আশা করা উচিৎ। অনেক সময় পরবর্তী বছরগুলোতে যখন তার সহ্য ক্ষমতা বেড়েছিল সে ওই মুহূর্তগুলোকে আবার মনে করতে চাইত। পারত কি না কে জানে! প্রথম মনে হয়েছিল যে বিশ্বজুড়ে এক সেতারের সবগুলো তার এক সঙ্গে বেজে উঠেছে। এটা তার মেরুদন্ডে শীতল স্রোত বইয়ে দিল। সে টের পেলো তার ঘাড়ের পেছনের ছোট রোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভয়ে- যা মানুষ পেত আদিম জঙ্গলে।
অভ্যস্ত হবার পর পর সে বুঝল যে, বরফের পাতগুলো মৃদু শব্দ করে সরছে। সন্দেহাতীতভাবে একটার সঙ্গে আর একটা লেগে যাচ্ছে। যদিও এখন বেশ দৃশ্যত নিরাপদই কিন্তু অবিশ্রান্ত সমুদ্রের গর্জনের মতোই এটা বন্ধ হচ্ছে না।
যতই সে শুনতে লাগল, ততই ক্যারিনার মনে হচ্ছিল নির্জন সৈকতে অশান্ত ঢেউয়ের শব্দের কথা। তার মনে হল সে যেন বিশ্বজুড়ে আছড়ে পরা মহাশূন্যের সমুদ্রের গর্জন শুনছে–এমন এক গর্জন যা মহাবিশ্বের মহাশূন্যতার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে আতংকের জন্ম দেয়।