কয়েক দশক লেগেছিল উত্তরটা আসতে এবং আরও কয়েক দশক সব বুদ্ধিমান মানুষের স্বীকার করতে যে খারাপ জিনিস ভালো জিনিসের মতোই আসে। অনেক আগে থেকেই যা সন্দেহ করা হচ্ছিল, তাই সত্যি- মহাবিশ্বও সহজভাবে গানিতিক সম্ভাবনাকে মেনে চলে। আসলেই সেখানে কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব নেই না ভালো না মন্দ। তাই অশুভ শক্তির ব্যাপারটা আর রইল না। মহাবিশ্বকে দয়ালু ভাবার মানেটা হচ্ছে ভাগ্য নির্ভর একটা খেলার প্রতিটিতে জেতা।
অবশ্য তারপরও কোন কোন ধর্মগোষ্ঠী তাদের আলফাঁকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। তারা উচ্চ কণ্ঠে বলত আলফার ধর্ম অভিন্ন এবং একটা ঘন্টার মতো রূপক তাদের বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দেখাত। বলাই বাহুল্য এতো বিমূর্ত জিনিস খুব বেশী উৎসাহ আনেনা। গণিতের আরেকটা জিনিস আলফাঁকে আঘাত করেছিল। একজন প্রতিভাবান তেরান, কূট গোডলে প্রমাণ করে যে জ্ঞানের মৌলিক কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তাই সর্বজ্ঞানী সত্ত্বা যা কিনা আলফার একটা সংজ্ঞা যুক্তিসম্মত নয়।
শেষ সহস্রাব্দের মাঝে আলফা মানুষের মন দিয়ে প্রায় মুছেই গেল। সব চিন্তাশীল মানুষই মহান দার্শনিক লিওক্রিস্টাসের কঠিন মন্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন, সমস্ত ধর্মই আসলে অনৈতিক, কারণ অলৌকিক বিশ্বাস ভালোর চাইতে খারাপটাই বেশী ছড়িয়েছে। যদিও কিছু পুরোনো বিশ্বাস টিকে ছিল একদম শেষ পর্যন্ত, তবে পুরোটাই পাল্টে গিয়ে। শেষ দিকে মর্মন এবং নবীর মেয়েরা নিজেরাই বীজবহনকারী মহাকাশযান বানিয়েছিল। আমার জানতে ইচ্ছে হয়, সেগুলোর কি অবস্থা।
আলফা মুছে গেলে, টিকে ছিল ওমেগা, সব কিছুর স্রষ্টা। একে মোছা সহজ ছিল, এবং মহাবিশ্ব কিছুটা প্রমাণ দিত। দিত কি? একটা পুরোনো দার্শনিক কৌতুক বলি– যেটা আসলে বেশ সূক্ষ্ম। প্রশ্ন মহাবিশ্ব এখানে কেন? উত্তর, আর কোথায় এটা থাকতো? আমার মনে হয় এক সকালে এই যথেষ্ঠ।–ধন্যবাদ মোজেস, মিরিসা বলল। তাকে সামান্য বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তুমি এগুলোর সবই আমাকে বলেছ। নয় কি?
-অবশ্যই বহু বার। এবং প্রতিজ্ঞা করো।
-কি?
-আমি যা বলেছি তার একফোঁটাও বিশ্বাস করোনা। কোন জটিল দার্শনিক সমস্যার কখনোই সমাধান হয় না। ওমেগা তো এখনও টিকে আছে। আর মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি আলফা…
৪৭. ফুলকীগুলো উপরে উঠে যায়
ফুলকীগুলো উপরে উঠে যায়
৪৭. উপথে যাত্রা
তার নাম ক্যারিনা, আঠারো বছর বয়স। যদিও এটাই তার কুমারের নৌকায় রাত্রের আঁধারে প্রথম ভ্রমণ। তবে অবশ্যই তার প্রথম শোয়া নয়। সেই কুমারের পছন্দের মেয়ে, এমন একটা কথা অনেকেই বলে থাকে।
সূর্য অনেকটা আগেই ডুবে গেছে। ভিতরের চাঁদটা পৃথিবীর চাঁদের চাইতেও অনেক কাছে এবং তার উজ্জ্বল ঠান্ডা, নীল আলো আধমাইল দূরের সৈকতকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। পাম গাছের সারি থেকে আধমাইল দূরে আগুন জ্বলছে। সেখানে এখনও উৎসব চলছে। সবচেয়ে কম শক্তিতে চলতে থাকা ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ ছাড়িয়েও মাঝে মাঝে হালকা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। কুমারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং আর কিছু চাইবার ইচ্ছে তার আপাতত নেই। খুব ভালো নাবিক বলেই সে মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয় চালককে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল এবং চার পাশ দেখছিল। কুমার ক্যারিনাকে সত্যিকারের সুখের কথা বলছিল। নৌকার মৃদু দোলানীটা যখন বাতাসের কুশনে (যার উপরে তারা শুয়ে আছে) আরও বেড়ে যায় তখন তার মধ্যে খুব উত্তেজক একটা অনুভূতি থাকে। এর পরে শুকনো জমিতে ভালোবাসাবাসি করতে কি ক্যারিনার আর ভালো লাগবে? কুমার ক্যারিনার পরিচিত আর দশটা যুবকের চাইতে অনেক বেশী সংবেদনশীল, সহনশীল। সে ওরকম নয় যারা শুধু নিজের তৃপ্তি খুঁজতেই ব্যস্ত। অন্যজন উপভোগ না করলে তার আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না। ক্যারিনা ভাবল যখন সে আমার মধ্যে থাকে মনে হয় যে আমি বিশ্বের একমাত্র মেয়ে, যদিও আমি ভালোভাবেই জানি তা নয়।
ক্যারিনা মৃদুভাবে টের পাচ্ছিল তারা গ্রাম ছেড়ে আরো দূরে যাচ্ছে, তবে সে কিছু মনে করেনি। তার মনে হচ্ছিল যদি এ সময় না ফুরাতো- যদি এই নৌকাটা চলতেই থাকতো। তীর থেকে দূরে গিয়ে পুরো গ্রহকে চক্কর মেরে আবার তা ফিরে আসত। কুমার অবশ্য ভালোভাবেই জানতো সে কি করছে। তার বিশ্বাসটাও ক্যারিনাকে আনন্দ দিচ্ছিল। কুমারের নিরাপদ বাহুর আশ্রয়ে কোন ভয় নেই, সমস্যা নেই, কোন ভবিষ্যত সামনে দাঁড়িয়ে নেই, আছে শুধু অন্তহীন বর্তমান।
তবুও সময় যায়। এখন ভেতরে চাঁদ আকাশের অনেক উপরে। ভালোবাসার দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন তাদের ঠোঁটগুলো শরীরের ভালোবাসার খাজগুলো আবিষ্কারে ব্যস্ত তখন পানির জেট এবং নৌকাটা থেমে গেল।
-আমরা এসে গেছি, কুমার বলল। তার গলায় হালকা উত্তেজনা।
এসে গেছি’ মানেটা কি? ক্যারিনা অলসভাবে ভাবল। ঘন্টা খানেকের মতো। তারা তীরের দিকে তাকায়নি। যদিও এটা দৃষ্টিসীমার মধ্যেই আছে। নৌকার মৃদু দোলানীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। সে বড় বড় চোখ করে তাকালো তার সামনের স্বপ্নের জায়গাটার দিকে, যেটা কিছু দিন আগেও ছিল ম্যানগ্রোভ বনের পরিত্যক্ত ভূমি।
অবশ্য উচ্চত, প্রযুক্তির সঙ্গে এটাই তার প্রথম সাক্ষাত নয়। ফিউশন প্ল্যান্ট এবং প্রধান রেপ্লিকেটর আরও বড় এবং গুরুগম্ভীর। কিন্তু চকচক করে চলতে থাকা জটিল পাইপের সারি, এই সংমিশ্রণের প্রতিটি জিনিস যা মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই নিঃশব্দে কাজ করছে তা সত্যিই অপার্থিব। কুমারের নোঙর ছোঁড়ার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলল।