খুব কম সরকারই তাদের সামনের নির্বাচনের বেশী ভাবতে পারে, বা খুব কম লোকই তাদের নাতিদের পরের সময়কে দেখতে পায়। আর জ্যোতির্বিদদের ভুল হবার সম্ভাবনা তো রয়েই যাচ্ছে…।
মানব জাতির মৃত্যুর পরোয়ানা এলেও, মৃত্যুর দিনটা তখনও অনিশ্চিত। আর সূর্য যেহেতু আগামী এক হাজার বছরের মধ্যে ধ্বংস হচ্ছে না সুতরাং কে আর চোদ্দ পুরুষের পরের ধ্বংসের জন্য কান্নাকাটি করে।
৫. নিশি যাত্রা
ব্র্যান্ট, মেয়র ওয়াডের্ন, কাউন্সিলর সিমন্স, দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠকে নিয়ে যখন গাড়ীটা তারনার বিখ্যাত পথ ধরে যাচ্ছিল, তখন দুটো চাঁদের একটাও আকাশে ওঠেনি। যদিও ব্র্যান্ট তার স্বাভাবিক দক্ষতায় গাড়ীটা চালাচ্ছিল, কিন্তু মনে মনে মেয়রের কড়া কথার জন্য সে জ্বলছিল। এমনকি মেয়রের হাত তার ভোলা কাঁধ অসতর্ক ভাবে ছুঁয়ে থাকলেও জিনিসটা সে ভুলছিল না। রাতের শান্ত সৌন্দর্য, আর পাম গাছের সম্মোহনী ছন্দ, তার স্বাভাবিক রসবোধকে শিগগিরিই ফিরিয়ে আনল। আর এমন ঐতিহাসিক একটা মুহূর্তে, নিজস্ব ক্ষুদ্র অনুভূতি কিভাবে আসতে পারে? দশ মিনিটের মধ্যে তারা প্রথম অবতরণের স্থান যেখান থেকে তাদের ইতিহাস শুরু সেখানে চলে আসল। এখানে কি অপেক্ষা করছে? একটা জিনিস নিশ্চিত, যে আগুন্ত-করা প্রাচীন বীজ বহনকারী মহাকাশযানের অনির্বান আলোকসঙ্কেতের সঙ্গে পরিচিত। তারা এটাও জানে যে কোথায় খুঁজতে হবে। সুতরাং নিশ্চয়ই এটা মহাশুন্যের এদিককার কোন কলোনী থেকে এসেছে।
হঠাৎ করেই ব্র্যান্ট একটা বিদঘুঁটে চিন্তায় ধাক্কা খেল। যে কেউ বা কিছু আলোকসংকেত দেখতে পারে, যা কিনা বুদ্ধিমত্তার কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে মহাবিশ্বে। তার মনে পড়ল কয়েক বছর আগেই এটাকে বন্ধ করে দেবার কথা উঠেছিল। কারণ এর কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই। বরং এটা কোন ক্ষতিই করতে পারে। সামান্য ভোটে প্রস্তাবটা বাতিল হয়–অবশ্য কোন যৌক্তিক কারণে নয় বরং আবেগের জোয়ারেই। থ্যালসা হয়তো খুব শিগগিরি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ করবে। যদিও তখন আর কিছুই করার থাকবে না।
কাউন্সিলর সিমন্স পিছনের আসন থেকে ঝুঁকে মেয়রকে বললেন, হেলগা। ব্র্যান্ট এই প্রথম তাকে মেয়রের প্রথম নাম ধরে ডাকতে শুনল। তুমি কি মনে কর আমরা যোগাযোগ করতে পারব। তুমি তো জান রোবটের ভাষা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
মেয়র জানে। তবে সে তার অজ্ঞানতা লুকিয়ে ফেলতে আরও ভালো জানে।
-সেটা সমস্যার সবচে ঘোট অংশ। আগে তো পৌঁছাই। আর ব্র্যান্ট, তুমি কি একটু আস্তে চালাতে পারো না? আমি ওখানে জীবিত পৌঁছুতে চাই। এই পরিচিত রাস্তায় বর্তমান গতি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারপরও ব্র্যান্ট গাড়ীর গতি কমালো। ব্র্যান্ট ভাবল, মেয়র কি মুখোমুখি হওয়াটা এড়াতে চাইছে। অবশ্য গ্রহের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কোন মহাকাশযানকে মোকাবেলা করা বিশাল দায়িত্বের কাজ। পিছনের সীট থেকে একজন বলে উঠল।
-ক্র্যাকান! কেউ কি ক্যামেরা এনেছে?
-ফিরে যাবার সময় নেই। ছবি তোলার জন্যে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় না, তারা “হ্যালো” বলেই চলে যাবে।
তার গলা অবশ্য সামান্য হিস্টিরিয়ার মতো শোনাল। ব্র্যান্ট তাকে দোষ দিল না। কে জানে, পরবর্তী পাহাড়ের পর তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?
মেয়র গাড়ীর রেডিওতে বললেন,
-কিছু বলার মতো থাকলে আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বলব মিঃ প্রেসিডেন্ট। ব্র্যান্ট বার্তাটা শুনতেই পায়নি। সে এতোটাই তার স্বপ্নে মগ্ন ছিল। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার মনে হল ইতিহাসটা আরেকটু শেখা উচিত ছিল।
তবে অবশ্যই সে মূল তথ্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত। থ্যালসার প্রতিটা শিশুই ওগুলো জেনে বড় হয়ে ওঠে। সে জানে কিভাবে নির্মমভাবে এগিয়ে আসছিল টিক টিক করে শতাব্দীগুলো। আর জ্যোতির্বিদদের দেয়া সময়টাও নির্ভুল হয়ে আসছিল। ৩৬০০ খ্রীস্টাব্দে, অবশ্য ৭৫ বছর এদিক ওদিক হতে পারে, সূর্য নোভায় পরিণত হবে। খুব বিশাল কিছু নয়। তবে যথেষ্ঠ পরিমানেই বড়।
এক প্রাচীন দার্শনিক একবার বলেছিলেন যে পরদিন সকালে ফাঁসির আদেশ একজন মানুষের মনকে আশ্চর্যভাবে স্থির করে দেয়। চার হাজার সালের দিকে পা দেবার সময় ঠিক এমন একটা অবস্থা হল সমগ্র মানবজাতির। ২৯৯৯ থেকে ৩০০০ সালের পা দেয়ার ৩১ শে ডিসেম্বর শেষ মুহূর্তে সমগ্র মানবজাতি এক মুহূর্তে এই সত্যটি উপলব্ধি করল যে, ৩ থেকে ৪ এর পরিবর্তন দেখার জন্য কেউ থাকবে না।
অবশ্য এখনও আরও পাঁচশ বছর আছে। আরও যে তিরিশটা প্রজন্ম আসবে তারা ইচ্ছে করলে তাদের পূর্বপুরুষদের মতো অনেক কিছুই করতে পারবে। অন্ততঃ তারা তাদের জাতির জ্ঞান আর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলোকে রক্ষা করতে পারবে।
এমনকি মহাকাশ যুগের একদম প্রথম দিকেও রোবট চালিত মহাকাশযানগুলো সৌরজগতের বাইরে সঙ্গীত, বার্তা আর ছবি নিয়ে যেত এই উদ্দেশ্যে যে, যদি তা মহাবিশ্বের অন্য কোন অনুসন্ধানীর হাতে পরে। যদিও নিজস্ব গ্যালাক্সীতে বুদ্ধিমান কোন জীবের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি সবচে আশাবাদীরাও বিশ্বাস করে যে হয়তো অন্য লক্ষ গ্যালাক্সীর কোথাও না কোথাও বুদ্ধিমান জীব আছে।
তাই শত বছর ধরে মানব জাতির জ্ঞান আর সভ্যতার টেরাবাইট, টেরাবাইট তথ্য এন্ড্রোমিডা নেবুলা আর তার দূরবর্তী প্রতিবেশীদের জন্য পাঠানো হয়েছে। অবশ্য কেউই জানে না যে ওই সঙ্কেতগুলো কেউ ধরেছিল কিনা, কিংবা ধরলেও সেটা বুঝতে পেরেছিল কিনা। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল একটাই। শেষ একটা তথ্য রেখে যাওয়া মানব জাতির পক্ষ হতে-দেখ একদিন আমিও বেঁচে ছিলাম।