এটা অবশ্য ব্যাখ্যার কোন দরকার ছিল না। সবাই জানে আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণের অসুবিধা আর ব্যয়ের কথা। যদি যান্ত্রিক উৎকর্ষতায় সম্ভবও হয়, রোবটরা হাজার গুণ শস্তায় তা করে দেবে।
মেয়র বললেন–এটা হয়ত আমাদের সমস্যা নয়। সবাই ভাবছে যে, আমাদের এখানেই অবতরণ হবে, কিন্তু কেন? উত্তর দ্বীপ তো আরও বেশী…
মেয়র প্রায়ই ভুল প্রমাণিত হন, তবে এতো দ্রুত কখনোই নয়। শব্দটা যখন তারনার আকাশে হল, সেটা অবশ্যই আয়োনোস্কেয়ার হতে কোন গর্জন নয়। বরং দ্রুত গতির একটা জেটের শীষ। প্রত্যেকে কাউন্সিল চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। প্রথম কয়েকজন কেবল দেখতে পেল যে, ভোতা মাথার একটা জিনিস পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্রের পবিত্র স্থানটিতে নামছে।
-ব্র্যান্ট, তুমি সেখানে দ্রুত যেতে পারবে। তোমার ঘুড়িটা বের কর।
তারনার প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অবাক হয়ে তাকালো। এই প্রথম সে। মেয়রের কাছ থেকে সরাসরি কোন নির্দেশ পেল।
-একটা নারকেল কয়েকদিন আগে ডানায় লেগেছে। মাছ ধরার ফাঁদের কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি মেরামতের সময় পাইনি। এছাড়া এটা রাতে ওড়ার জন্য উপযুক্ত নয়। মেয়র কঠিন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন,
-আমার গাড়ীটা কি কাজ করছে?
–অবশ্যই, জ্বালানী ভর্তি।
এটা অবশ্য অস্বাভাবিক যে মেয়রের গাড়ী কোথাও যাবে। বিশ মিনিটের মধ্যে যে কেউ তারনা হেঁটে ফেলবে। আঞ্চলিক খাবার আর যন্ত্রপাতি ছোট ঠেলাগাড়ীতে যায়। সত্তর বছরের অফিসিয়াল সার্ভিসে গাড়িটিকে একশ হাজার কিলোমিটারেরও কম পথ যেতে হয়েছে। দুর্ঘটনা না হলে এটা আরও একশ বছর কমপক্ষে চলবে। কেউ অবশ্য ভাবেনি যে, যাত্রীদের চাইতে বয়স্ক এই গাড়ীটা এরকম একটা ঐতিহাসিক যাত্রা করবে।
৪. সতর্ক সংকেত
পৃথিবীর বিদায় ঘন্টা বাজার প্রথম শব্দটা কেউ শুনতে পায়নি। এমনকি যে বৈজ্ঞানিক কলোরাডোর পরিত্যক্ত সোনার খনিতে, মাটির বহু নীচে সেই ভয়ংকর আবিষ্কারটা করেছিলেন, তিনিও না।
এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক পরীক্ষা। বিংশ শতাব্দীর মাঝ পর্যন্ত যা একেবারেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। নিউট্রিনো আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল যে, মানবজাতি মহাবিশ্বের এক নতুন জানালা খুলেছে। পাতলা কাঁচের মধ্যে দিয়ে আলো যাবার মতোই যা একটা গ্রহকে ভেদ করে, তা নক্ষত্রের ভেতর দেখতেও ব্যবহৃত হতে পারে।
বিশেষত সূর্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের ভেতরের শক্তি উৎপাদনকারী বিক্রিয়াগুলো সম্বন্ধে নিজেদের জ্ঞান নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। যার উপরে কিনা পৃথিবীর জীবন নির্ভরশীল। সূর্যের কেন্দ্রে অসম্ভব চাপ ও তাপে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং এক গুচ্ছ বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি নিঃসরিত হয়। এবং একই সঙ্গে তৈরী হয় একটা উপজাত- নিউট্রিনো। সৌর নিউট্রিনোগুলো তাদের জন্মস্থান থেকে বেরিয়ে পড়ে আলোর বেগে, আর ট্রিলিয়ন টনের ভর তাদের সামনে একখন্ড ধোয়ার বাধার বেশী কিছু মনে হয় না। দুই সেকেন্ডের মধ্যে তারা মহাশুন্যে পৌঁছে যায়। এবং মহাবিশ্বের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যত গ্রহ-নক্ষত্রই আসুক না কেন, তাদের অধিকাংশই ঐ সব “অলীক পদার্থ” কে ফাঁকি দিয়ে যায় এবং তখন সময়ও নিজের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়।
সূর্যকে ছাড়ার আট মিনিট পর, প্রবল সৌর নিউট্রিনো ধারার সামান্য অংশ পৃথিবীর ওপর দিয়ে যায় আর তারও সামান্য অংশ কলোরাডোর বিজ্ঞানীরা ধরতে পেরেছিলেন। তারা প্রায় এক কিলোমিটার মাটির গভীরে তাদের যন্ত্রপাতিগুলো বসিয়েছিলেন, যাতে অন্যসব স্বল্পভেদী বিকিরণগুলো আটকে যায় আর সূর্যের বুকের ভেতরকার দুর্লভ খাঁটি বার্তাবাহকদের যেন ধরা যায়। তাদের আশা ছিল, আটকাননা নিউট্রিনোগুলো দিয়ে বিস্তারিতভাবে গবেষণা করা, যা কিনা এতদিন মানুষের জ্ঞানের বা পর্যবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল।
পরীক্ষাটা সফল হলো, নিউট্রিনোও পাওয়া গেল। কিন্তু তা ছিল খুবই কম। বিশাল যন্ত্রগুলো ঠিক হলে, তিন থেকে চারগুণ নিউট্রিনো পাবার কথা।
পরিষ্কার বোঝা গেল যে কিছু একটা ভুল আছে। এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই হারানো নিউট্রিনোগুলো একটা বৈজ্ঞানিক বদনাম হিসেবেই টিকে রইল। যন্ত্রপাতিগুলো বারবার পরীক্ষা করে দেখা হলো, তত্ত্বগুলো খুটিয়ে দেখা হলো এবং কয়েকবার পরীক্ষাটা করে দেখা হলো। কিন্তু প্রতিবারই সেই হতবুদ্ধিকর ফলাফল।
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, জ্যোতিপদার্থবিদরা একটা বিরক্তিকর সমাধানে পৌঁছুতে বাধ্য হলেন, যদিও কেউই এর পরিপূর্ণ প্রভাব বুঝল না।
আসলে যন্ত্রেরও কোন দোষ নেই। তত্ত্বেরও নেই। সমস্যাটা হচ্ছে সূর্যের ভেতরে। আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের ইতিহাসের প্রথম গোপন মিটিংটা হয়েছিল ২০০৮ সালে অ্যাসপানে-কলোরাডোতে প্রাথমিক পরীক্ষার স্থান থেকে খুব একটা দূরে নয়–যে পরীক্ষাটা কিনা এখন অনেকগুলো দেশেই হচ্ছে। এক সপ্তাহ পর ইউনিয়নের বিশেষ বুলেটিন নং ৫৫/০৮ “সৌর বিক্রিয়া নিয়ে কিছু তথ্য” শিরোনামে সমস্ত সরকারের হাতে পৌঁছে দেয়া হলো। কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে,পৃথিবী ধ্বংসের খবরটা আস্তে আস্তে ফাঁস হয়ে গেলে, বেশ একটা ভীতির সৃষ্টি হবে। বাস্তবে সাধারণ প্রতিক্রিয়া হল এরকম- হঠাৎ একটু চুপ, তারপর কাঁধ ঝাকুনী দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাওয়া।