ব্র্যান্ট এতোটাই অবাক হল যে, লোরেন হেসে দিল।
-তুমি আমাকে অবাক করতে চাইছ! বেশ তুমি এটা অন্ততঃ প্রমাণ করেছ যে সাগরে অনেক জিনিস আছে যা আমার কল্পনারও বাইরে। কিন্তু এমন কিছু জিনিস ওখানে আছে, যার কল্পনা করা তোমারও অসাধ্য।
২০. স্বপ্ন সময়
তারনার লোকজন প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না। তারা মজা করেই বলল,
-প্রথমে তুমি বললে যে তুমি কখনো বোটে ওঠনি। আর আবার এখন তুমি বলছ যে, তুমি সাইকেল চালাতে জানো।
-তোমার লজ্জা হওয়া উচিত- মিরিসা চোখ টিপে স্ক্রিপ করল। যাতায়াতের সবচাইতে কার্যকর পদ্ধতিটা তুমি কখনো চেষ্টাই করনি।
-মহাকাশযানে তো আর ব্যবহার হয় না। ওদিকে শহরের জন্য ওটা খুব বিপদজনক। লোরেন বাঁচতে চাইল, ঠিক আছে, শিখে নেব।
এবং খুব শিগগিরি সে আবিষ্কার করল, দেখতে যেমন সোজা লাগে বাইসাইকেলে চড়া তার চাইতে ঢের কঠিন। অবশ্য এই ছোট চাকার মেশিনটা যার ভারকেন্দ্র অনেক নীচে, সেখানে থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। তবে প্রাথমিক চেষ্টাটা তার জন্য বেশ হতাশাব্যঞ্জকই ছিল। সে হয়তো ছেড়েই দিত, যদি না মিরিসা তাকে বোঝাত যে এটাই দ্বীপটাকে চেনার জন্য সবচে ভালো বাহন। আর তার নিজস্ব আশাটা হল অবশ্য, মিরিসাকে চেনার জন্যও এটাই সবচে ভালো বাহন।
প্রাথমিক কিছু অসুবিধার পর সে বুঝতে পারল কৌশলটা আসলে চালানোর সমস্যাটাকে সজ্ঞান চিন্তার ওপর ছেড়ে না দিয়ে, শরীরের নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। এটাই যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত। কেউ যদি প্রতিটি পদক্ষেপই চিন্তা করে দিতে চায়, তবে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা একেবারেই অসম্ভব হবে। অবশ্য এই উপলদ্ধিটাকে বুদ্ধি বৃত্তির ভেতর ঠাই দিতে লোরেনের কিছুটা সময় লাগল। আর একবার এই বাধা অতিক্রম করার পর, পরবর্তী অগ্রগতিটা হল দ্রুত। এবং সবশেষে তার আশা অনুযায়ীই মিরিসা তাকে দূরের পথগুলোতে ঘোরার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
বসতি থেকে পাঁচ কিলোমিটারও তারা আসেনি। অথচ এর মধ্যেই মনে হচ্ছে যে এই বিশ্বে এখন শুধু তারাই দু’জন আছে। অবশ্য সত্যিকার অর্থে সাইকেল চালানোর সরু পথে তারা তার চাইতে বেশী পথই অতিক্রম করেছে। পথটা সবচাইতে লম্বা করার জন্যই ছবির করে মতো করে তৈরী করা হয়েছে। অবশ্য লোরেন খুব সহজেই তার তাৎক্ষণিক স্থান নির্ণায়ক যন্ত্রটির মাধ্যমে নিজের অবস্থান বের করতে পারে, কিন্তু তার তা করতে ইচ্ছে করছে না। হারিয়ে গেছে- এমন চিন্তা করতেই বরং ভালো লাগে।
যন্ত্রটাকে রেখে আসলেই মিরিসা খুশী হতো।
-ওটা কেন তোমাকে নিতেই হবে? তার বাম কব্জির ব্যান্ডটা দেখিয়ে সে বলল, মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন থাকতেই তো ভালো লাগে।
-আমি জানি, কিন্তু মহাকাশযানের নিয়ম কানুন খুব কড়া। যদি ক্যাপ্টেন বের জরুরী দরকার হয় আর আমি উত্তর দিতে না পারি?
-কি, কি করবে সে? তোমাকে জেলে ভরবে?
–তার ঝাড়ি খাবার চাইতে সেটাই আমি পছন্দ করব। আমি অবশ্য এটাকে নিষ্ক্রিয় রেখেছি। যদি তারপরও মহাকাশযান থেকে যোগাযোগ করে তাহলে সেটা অবশ্যই একটা জরুরী অবস্থায় করবে। আমাকে যেতেই হবে।
হাজার বছর ধরে সমস্ত তেরানদের মতোই লোরেন বরং জন্মদিনের পোশাকে থাকতে চাইবে, কিন্তু ওই যন্ত্রটা ছাড়া সে থাকবে না। পৃথিবীর ইতিহাস অসংখ্য বেপোরোয়া এবং নির্বোধ লোকদের ভয়ংকর মৃত্যুর কাহিনী দিয়ে পূর্ণ-যারা নিরাপদ স্থানের মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যে মারা গেছে শুধু মাত্র লাল জরুরী বোতামটায় চাপ না দিতে পারায়।
সাইকেল চালানোর রাস্তাটা নিঃসন্দেহে কোন বড় যানবাহনের জন্য তৈরী হয়নি। এটা এক মিটারেরও কম চওড়া। লোরেনের প্রথম মনে হচ্ছিল সে যেন একটা রশির ওপর দিয়ে চলছে। ঠিক থাকার জন্য সে মিরিসার পেছন দিকে তাকিয়ে ছিল এবং সেটা খুব একটা প্রীতিকর কাজ নয়। তবে কয়েক কিলোমিটারের পর তার আত্মবিশ্বাস চলে এল। সে পাশের দৃশ্য উপভোগ আরম্ভ করল। অন্যদিক থেকে কাউকে আসতে দেখলে দু’পক্ষকেই নেমে যেতে হবে। পঞ্চাশ ক্লিক গতিবেগে চলা দুটো সাইকেলের সংঘর্ষ চিন্তাই করা যায় না। বিধ্বস্ত একটা বাই সাইকেল নিয়ে বাসার দূরত্বটা একটু বেশীই হয়ে যায়।
রাস্তাটা নিথর, নিস্তব্ধ, মিরিসা কোন অন্যরকমের গাছ বা সুন্দর জায়গা দেখানোর সময় থেমে যাচ্ছিল। এরকম নিস্তব্ধতার অভিজ্ঞতা লোরেনের সারা জীবনে হয়নি। পৃথিবী সব সময়ই শব্দময় ছিল-আর মহাকাশযানের জীবনতো পুরোটাই যান্ত্রিক শব্দের ছন্দে ভরা, কেবল মাঝে মাঝে ভয়ংকর সব অ্যালার্মের শব্দ ছাড়া।
আর এখানে গাছগুলো যেন একটা অদৃশ্য, শব্দশোষণ করা কম্বলে ঢাকা। তাই প্রতিটি শব্দই মুখ থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। প্রথম প্রথম এটা ভালোই লাগে। কিন্তু লোরেনের এখন মনে হচ্ছে, এই শূন্যতা ভরার মতো কিছু থাকা উচিত। একবার সে মনে করল তার যোগাযোগের যন্ত্রের হালকা আবহ। সঙ্গীতটা বাজায়। কিন্তু মিরিসার আপত্তির কথা মনে রেখে, সেটা আর করা হল না।
তাই যখন দূরের গাছগুলোর ভেতর দিয়ে পরিচিত হয়ে আসা থ্যালসানদের নাচের সুর শুনতে পেল সে রীতিমতো অবাকই হল। কিন্তু সরু রাস্তাটা যেহেতু দু’তিনশ মিটারের বেশি খুব একটা সোজা যায় না তাই একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার আগ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারল না, সুরটা কোত্থেকে আসছে। বাঁকের পরই একটা বিশাল সুরময় যন্ত্র তাদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল। তারা নেমে যখন এটাকে পাশ দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল, তখন লোরেন বুঝল যে, আসলে জিনিসটা কি। এটা একটা স্বয়ংক্রিয় রাস্তা মেরামতকারী।