-আমাকে ও শিখিয়েছে। কোন মহাশূন্যচারীকে ফোন করে প্রদক্ষিণের সময়টা জানবে আর তারপর চিৎ হয়ে কেবল শুয়ে থাকলেই চলবে। ঠিক মাথার উপরে খুব উজ্জ্বল তারার মতো এটা চলতে থাকে। মনে হয় যেন, এটা একদম নড়ছে না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও যদি অন্যদিকে তাকাও এটাকে তুমি হারিয়ে ফেলবে।
হঠাৎ করেই কুমার ইঞ্জিনটা পুরো বন্ধ করে দিল। লোরেন অবাক হয়ে দেখল যে তারনা অন্ততঃপক্ষে এখনও এক কিলোমিটার দূরে। এ জায়গাটার পাশেই “প লেখা আর লাল পতাকা ওড়ানো একটা বড় বয়া ভাসছে।
-বন্ধ করলে কেন? লোরেন জিজ্ঞেস করল।
কুমার ছোট একটা পাত্রকে সমুদ্রে খালি করছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা এতোক্ষন বন্ধ ছিল।
ভেতরের জিনিসটা অনেকটা রক্তের মতো দেখতে হলেও গন্ধটা খুবই ভয়ংকর। বোটের ছোট্ট সীমার মধ্যে লোরেন যতটা পারল চেপে গেল।
-একজন পুরোনো সাথীকে ডাকছি। ব্র্যান্ট খুবই নরম ভাবে বলল। নড়ো না, শব্দ করো না। সে আবার খুব নার্ভাস।
-সে? লোরেন চিন্তা করল। কি হচ্ছে এসব?
পাঁচ মিনিটের মধ্যে কিছুই হলো না। লোরেন না দেখলে বিশ্বাসই করত না যে কুমার এতোক্ষন নিথর হয়ে বসে থাকতে পারে। তারপর সে দেখল বোট থেকে কয়েক মিটার দূরে, পানির নীচে থেকে একটা কালো, বাকা মতো জিনিস উঠে আসছে। সে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝল, যে এটা একটা বৃত্ত তৈরী করে তাদের ঘিরে ফেলছে। একই সঙ্গে ঠিক ঐ মুহূর্তে বুঝতে পারল যে, কুমার আর ব্র্যান্ট ঐ জিনিসটা দেখছে না, দেখছে তাকে। আচ্ছা তাহলে তারা আমাকে অবাক করতে চাচ্ছে–সে নিজেকেই বলল। বেশ দেখা যাক…
তারপরও যখন লোরেন তার চারপাশে উজ্জ্বল-না, বরং বলা যায় পচে যাওয়া, গোলাপী মাংসের স্তূপকে সমুদ্র থেকে জেগে উঠতে দেখল, তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সে চিৎকার দেয়া থেকে বিরত হল। এটা তাদের চারপাশে প্রায় আধা মানুষ সমান উঁচু, গোলাপী একটা দেয়াল তৈরী করেছে। আর সবচে ভয়ংকর হল। এর উপরের অংশটা প্রায় পুরোটাই লাল-নীল রং এর মোচরানো সাপ দিয়ে ঢাকা।
গভীর সমুদ্র থেকে অসংখ্য লতানো বাহুসহ একটা বিশাল মুখ তাদের গ্রাস করতে এল… তবে নিশ্চিত যে কোন বিপদ নেই। তার সঙ্গীদের ভাব-ভঙ্গীই তা প্রমাণ করে।
-ওহ ঈশ্বরের, ক্র্যাকানের কসম কি এটা? সে প্রাণপনে গলা স্বাভাবিক রেখেই বলল।
-তুমি চমৎকার সামলেছো? কুমার প্রশংসার সুরে বলল। অনেকে বোটের তলায় গিয়ে লুকায়। এটা অমেরুদন্ডী প্রানীর একটা সমষ্টি, বিশেষ ধরনের বিলিয়ন কোষের সমষ্টি যা একসঙ্গে কাজ করে। এধরনের জিনিস তোমাদের পৃথিবীতেও ছিল–তবে হয়তো এতো বড় নয়।
-তুমি নিশ্চিত থাক সে ব্যাপারে-লোরেন উত্তর দিল। আর যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? এটাকে কিভাবে এখানে আনলে? ব্র্যান্ট কুমারের দিকে মাথা ঝাঁকাল। সে তখন ইঞ্জিনকে পুরো শক্তিতে আনতে ব্যস্ত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চারপাশের জীবন্ত দেয়ালটা অসম্ভব দ্রুততায় আবার গভীরে চলে গেল। একটা বৃত্তাকার পানির ঢেউ ছাড়া আর কোন চিহ্নই রইল না।
-এটা কম্পনকে ভয় পায়, ব্র্যান্ট ব্যাখ্যা দিল। পর্যবেক্ষণ কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখ, পুরো প্রাণীটাকেই দেখতে পাবে।
তাদের নীচে দশ মিটার পুরু, কাঠের ঘড়ির মতো একটা জিনিস সমুদ্র তলের দিকে ফিরে যাচ্ছে। লোরেন এতোক্ষণে বুঝল যে “সাপ” গুলো হচ্ছে কেবল সাঁতারের জন্য লতানো বাহু। পানির ভেতর সেগুলো ভেসে আছে।
-কি দানবরে বাবা! এতোক্ষণ পরে সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল। একটা গর্ব, এমনকি প্রফুল্ল ভাব তার ওপর খেলা করছে। সে কুমার আর ব্র্যান্টের একটা পরীক্ষায় পাশ করেছে। ব্র্যান্ট আর কুমারের কাছ থেকে সে সম্মান আদায় করে নিয়েছে।
-জিনিসটা কি ভয়ংকর না?
–অবশ্যই। সে জন্যই তো ওই বিপদ সূচক বয়া দেয়া।
–সত্যি বলছি, ওটাকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
–কেন? ব্র্যান্ট আহত স্বরে জিজ্ঞেস করল, এটা তো কোন ক্ষতি করেনি।
–বেশ, ওরকম আকৃতির প্রাণী নিশ্চয়ই প্রচুর মাছ শিকার করে।
-হ্যাঁ–তবে আমরা শুধুই মাছ খাইনা। আর এই জিনিসটা কিভাবে মাছ ধরে তা নিয়েও বেশ প্রশ্ন ছিল। কারণ সবচে ক্যাবলা মাছগুলোও তো এর ভেতর সাঁতরে যাবে না। মানে দেখা গেল যে, কিছু রাসায়নিক জিনিস এটা নিঃসরণ করে। এরপরই আমরা বৈদ্যুতিক ফদের ব্যাপারে চিন্তা করি। যেটা আমাকে মনে করায় ব্র্যান্ট তার যোগাযোগের যন্ত্রটার দিকে ঝুকল।
-তারনা তিন। তারনা স্বয়ংক্রিয় রেকর্ডকে ব্র্যান্ট বলছি। তারটা ঠিক করা হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে। উত্তরের দরকার নেই। বার্তা শেষ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা পরিচিত স্বর সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়ে উঠল।
–হ্যালো ব্র্যান্ট, ড, লোরেনসন। শুনে খুশী হলাম। তোমাদের জন্য কিছু আকর্ষণীয় খবর আছে। শুনতে চাও?
-অবশ্যই মেয়র, দুজনের পারস্পরিক নিঃশব্দ সম্মতিতে ব্র্যান্ট উত্তর দিল। বলুন।
-কেন্দ্রীয় আর্কাইভ কিছু অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছে। এব্যাপারটা আগেও হয়েছে। আড়াই’শ বছর আগে উত্তর দ্বীপে বৈদ্যুতিক তলানী পদ্ধতির মাধ্যমে তার। রীফ বানাতে চেয়েছিল–যে পদ্ধতি পৃথিবীতে খুব ভালো কাজ দিয়েছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর পানির নীচের তারগুলো ছেঁড়া পাওয়া গেল-কিছু চুরিও হয়েছিল। পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল বলে জিনিসটা নিয়ে আর কোন ঘাটাঘাটি করা হয়নি। পানিতে অত খনিজই নেই কাজ করার মতো। সুতরাং রক্ষণশীলদের তুমি দোষ দিতে পারছ না। তাদের ওসময় অস্তিত্বই ছিল না।