-কাকু তুমি মন পরিবর্তন করনিতো? কুমার খোঁচা দিল।
লোরেন মাথা নাড়ল। অল্পবয়সী ল্যাসানদের এই সাধারণ ব্যবহৃত বিশেষণটি প্রথমে তাকে একটু ধাক্কা দিলেও, এখন অবশ্য হঠাৎ করে এতোগুলো ভাইঝি, ভাইপো পেতে ভালই লাগছে।
-না থাক। আমি এখান থেকেই দেখব, যদি তোমাদের হাঙরে খায় আর কি।
-হাঙর! কি চমৎকার প্রাণী। আমাদের এখানে যদি কিছু থাকতো! এটা ডুব দেয়াটা আরও উত্তেজনাকর করে ফেলত।
ব্র্যান্ট আর কুমারের যন্ত্রপাতি ঠিক করার ব্যাপারটা লোরেন একজন প্রযুক্তিবিদের উৎসাহ নিয়েই দেখল। মহাশূন্যে বের হতে যা পরতে হয় তার চাইতে এটা অনেক সহজ। প্রেসার ট্যাঙ্কটা এতোই ছোট যে হাতের তালুতে এটে যায়।
সে মন্তব্য করল,–অক্সিজেন ট্যাঙ্কটা তো কয়েক মিনিটের বেশি কাজ করবে না।
ব্র্যান্ট আর কুমার পরস্পরের দিকে তাকাল।
–অক্সিজেন! ফোঁস ফোঁস করে ব্র্যান্ট চেঁচাল। ওটাতো বিশ মিটার পানির নিচে মারাত্মক বিষ। বোতালটায় আছে কেবল বাতাস- তাও জরুরী প্রয়োজনে। পনেরো মিনিটের মতো চলে।
সে কানের পেছনের কানকোর মতো যন্ত্রটা দেখাল।–তোমার যা অক্সিজেন দরকার তা তো সমুদ্রের পানিতেই আছে। অবশ্য যদি তুমি তা বের করতে পার। পাম্প আর ফিল্টার চালানোর মতো শক্তি সম্পন্ন শক্তিকোষ থাকলেই হল। এরকম একটা যন্ত্র দিয়ে আমি দরকার হলে একসপ্তাহও থাকতে পারব। তার বাঁ হাতের কব্জিতে জ্বলজ্বল করা কম্পিউটার ডিসপ্লেতে সে চাপ দিল।
-এটা আমাকে সব তথ্য দেয়। গভীরতা, শক্তিকোষের অবস্থা, ওঠার সময়।
লোরেন আরেকটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল,
-তুমি একটা মুখোস পড়েছ! কুমার পরোনি কেন?
–না, আমি পড়েছি-কুমার হাসল। ভালো ভাবে খেয়াল কর।
–ওহ, আচ্ছা…খুব সূক্ষ্ম তো!
-তবে ওটা ফালতু ব্র্যান্ট বলল। যদি তুমি কুমারের মতো সত্যিকার অর্থেই পানিতে থাকতে চাও। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পানিটা খুব চোখে লাগে। সেজন্য আমি পুরনো মডেলটাই পছন্দ করি। ঝামেলা কম। তৈরি!
-তৈরী, কাপ্তান!
তারা একই সঙ্গে ঢালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাদের গতি এতোই মসৃণ যে, নৌকাটা মৃদু দুলল মাত্র। হালের কাঁচ দিয়ে লোরেন দেখল দু’জনে রশি ধরে সহজ ভাবে চলে যাচ্ছে। সে জানে দেখতে অনেক কম মনে হলেও তারা এখন প্রায় বিশ মিটার নীচে।
যন্ত্রপাতি তার আগেই ফেলা আছে। দুই ডুবুরী দ্রুত মেরামতে লেগে গেল। মাঝে মাঝে ইশারায় কথা বললেও, অধিকাংশ সময়েই তারা নিঃশব্দে কাজ করছিল। প্রত্যেকে নিজের এবং সঙ্গীর কাজ জানে, তাই কথার প্রয়োজনটা কি!
লোরেনের সময় খুব দ্রুত কাটছিল। তার মনে হচ্ছিল আসলেই সে একটা নতুন বিশ্বের দিকে তাকাচ্ছে। প্রাচীন সমুদ্রের ওপর অসংখ্য ভিডিও সে দেখলেও তার নীচের বয়ে যাওয়া এ জীবন সম্পূর্ণই তার অপরিচিত। সেখানে ছন্দময় গোলাকার জেলিফিস, তরঙ্গায়িত গালিচা বা ত্রুর মতো প্যাঁচ থাকলেও দ্রুত গতির সত্যিকার মাছ বলতে কোন জিনিস যা কল্পনায় আসে-তার অস্তিত্ব নেই। শুধু একটা টর্পেডোর মতো একটা জিনিস সে একবার দেখল। মনে হয় ওটা পৃথিবীরই কিছু। পানির তলের ইন্টারকমের মধ্যে কথা না শুনলে সে ভাবত, ব্র্যান্ট আর কুমার বুঝি তার কথা ভুলেই গেছে।
-আসছি। বিশ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক আছে?
-হ্যাঁ। যে মাছটা একটু আগে গেল সেটা কি পৃথিবীর?
-আমি দেখিনি।
-কাকু ঠিক বলেছে ব্র্যান্ট। পাঁচ মিনিট আগে প্রায় বিশ কেজির একটা ট্রাউট মাছ গেছে। তুমি তখন ওয়েল্ডিং করছিলে।
তারা এখন নোঙরের রশি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে। পাঁচ মিটার বাকী থাকতে তারা থামল।
প্রতিটি ডুবের এটা হচ্ছে সবচে একঘেয়ে অংশ ব্র্যান্ট বলল। আমাদের প্রায় পনের মিনিট থাকতে হবে এখানে। চ্যানেল ১২তে দাও, আর আস্তে–।
চাপমুক্ত হবার সময়কার গানটা নিশ্চয়ই কুমারের পছন্দ। এর তীব্র ঝংকার পানির নীচের ঐ শান্তির জীবনে একদম বেমানান। এর সুরের মধ্যে বন্দী না হওয়ায় লোরেন বেঁচে গেল এবং দুই ডুবুরী ওঠা শুরু করতেই সে ওটা বন্ধ করে দিল।
-সকালের কাজ বেশ ভালো হল ব্র্যান্ট কাঁপতে কাঁপতে বলল। ভোল্টেজ আর বিদ্যুৎ সমান। এবার আমরা ফিরতে পারি।
যন্ত্রপাতি খুলে রাখাতে লোরেন এর সাহায্য তারা কৃতজ্ঞ চিত্তেই নিল। দু’জনেই কয়েক কাপ উষ্ণ, মিষ্টি তরল (ল্যাসানে চা নামে পরিচিত হলেও পৃথিবীর ওজাতীয় কোন তরলের সঙ্গে তা মেলে না) খেতেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। কুমার ইঞ্জিন চালিয়ে রওয়ানা দিল আর ব্র্যান্ট গিয়ারের কাছে একটা ছোট রঙীন বাক্স খুলল।
-না, ধন্যবাদ-লোরেন বলল। যখন তাকে ব্র্যান্ট হালকা নেশার ট্যাবলেট দিল।
-আমি এমন কোন স্থানীয় অভ্যাস নিতে চাইনা যা কিনা সহজে ছাড়া যাবে না। কথাটা বলেই সে অনুতপ্ত হল। তার অবচেতন মনের পাপবোধই তাকে এই মন্তব্যটা করিয়েছে। ব্র্যান্ট অবশ্য এর অন্তর্নিহিত মানে বোঝার কোন লক্ষণ দেখালো না। সে মাথার নীচে হাত দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
-দিনের বেলাতেও কিন্তু ম্যাগেলানকে দেখা যায়–প্রসংগটা ঘোরানোর আশায় লোরেন বলল। অবশ্য ঠিক কোন জায়গায় থাকবে, তা তোমাকে জানতে হবে।
-আমি অবশ্য কখনো চেষ্টা করিনি-মিরিসা প্রায়ই দেখে।
কুমার মাঝখানে বলে উঠল।