নতুনত্বের কারণে এটা হয়নি। লোরেনের সঙ্গে দেখা হবার আগে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পৃথিবীবাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং কেউই তার মনে কোন বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। সূর্যের স্পর্শ ছাড়া ল্যাসানরাও কয়েকদিনের মধ্যে ওরকম হয়ে যাবে।
কিন্তু লোরেন অন্যরকম। তার চামড়া কখনোই তামাটে হবে না। আর তার চুল হয়তো আরও রূপালী হয়ে যাবে। অন্ততঃ মেয়র ওয়াডেনের অফিস থেকে দু’জন সহকর্মী নিয়ে বের হবার সময় তার সেরকমই মনে হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের চোখে ছিল হতাশ একটা দৃষ্টি-যা কিনা থ্যালসার অফিস এবং কঠিন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে একটা সাক্ষাতের পর প্রকাশ পাবেই।
এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখদুটো মিলেছিল। মিরিসা আরও কয়েকপা হেঁটে গিয়ে অবচেতন ভাবেই একদম থেমে পেছনে চেয়ে দেখতে পেল যে, আগন্তুক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন তারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে তাদের জীবন বদলে গেছে।
সে রাতেই ভালোবাসার ঝড় থামলে সে ব্র্যান্টকে জিজ্ঞেস করল,–তারা বলেছে, কতদিন থাকবে?
-আর সময় পেলে না জিজ্ঞেস করার, সে জড়ানো স্বরে বলল। অন্তত এক বছর। হয়তোবা দুই। ঘুমাও শুভরাত্রি।
আর যে কোন প্রশ্ন করা যাবে না, সেটা মিরিসা জানত। তবুও অনেকক্ষণ তার খোলা চোখ দেখল, কিভাবে ভেতরের চাঁদের দ্রুতগামী ছায়া মেঝের ওপর দিয়ে, তার পাশের গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মানুষটাকে কোমল ভাবে ছুঁয়ে সরে যায়।
ব্র্যান্টের আগে সে খুব বেশী লোককে চিনত না। কিন্তু একসঙ্গে থাকার পর অন্য কারও মধ্যে সে বিশেষ তেমন কিছু দেখেনি। কিন্তু তারপর এই হঠাৎ কৌতূহল কেন? সে এখনও একে কৌতূহলই বলতে চায়। তাও এমন একজনের প্রতি যে। কিনা তার প্রতি মাত্র কয়েকমুহূর্ত তাকিয়েছে আর তার ভালো নামটুকুও সে জানে না। মিরিসা নিজস্ব সততা আর পরিষ্কার চিন্তার জন্য গর্ব বোধ করত। যে সমস্ত মানুষ আবেগে চলে তাদের সে নীচু চোখেই দেখত। সে অবশ্য নিশ্চিত, তার। আকর্ষণের কিছুটা হচ্ছে নতুনত্বের-নতুন দিগন্তের হাতছানি। এমন কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হওয়া যে সত্যি সত্যি পৃথিবীর শহরগুলোতে হেঁটে বেড়িয়েছে, দেখেছে সৌরজগতের মৃত্যু, আর এখন যাচ্ছে এমন এক নতুন সূর্যের দিকে যার কল্পনা সবচে বুনো স্বপ্নটারও অসাধ্য। এটা তাকে ব্র্যান্টের সঙ্গের আনন্দের নীচে বয়ে চলা থ্যালসার অলস, একঘেয়ে জীবনের দুঃখ সম্বন্ধে সচেতন করে তুলল।
সত্যি সত্যি সে কি চায়? এই নক্ষত্রের আগন্তুকদের কাছে যে কি খুঁজছে সে নিজেও জানে না। তবে তারা যাবার আগে সে একবার চেষ্টা করে দেখবে।
ঐদিন সকালেই ব্র্যান্ট মেয়রের অফিসে গিয়েছিল। তবে বরাবরের মতো উষ্ণ অভ্যর্থনা সে পায়নি। সে তার মাছ ধরার ফাঁদের টুকরাগুলো ডেস্কে রাখল,–বুঝলাম যে তুমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে কি করবে?
মেয়র উৎসাহহীন ভাবে স্তূপ করা তারগুলো দেখল। নাক্ষত্রিক রাজনীতির মধ্যে দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপারই বটে!
-তোমার কি মনে হয়?–এটা ইচ্ছাকৃত। দেখ, কিভাবে না ভাঙ্গা পর্যন্ত তারগুলো মোচড়ানো হয়েছে।
একটা তার না, পুরো একটা অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার মনে হয় না। দক্ষিণ দ্বীপের কেউ এটা করবে। কি লাভ তাদের? তবে খুব শিগগিরি আমি বের করব… ব্র্যান্টের কথা হঠাৎ থেমে তারপরের অবস্থা বুঝিয়ে দিল।
-কাকে সন্দেহ হয়?
-যখন থেকে আমি বৈদ্যুতিক ফাঁদ নিয়ে কাজ করছি তখন থেকেই রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তারা ভাবে যে, সমস্ত খাদ্যকেই কৃত্রিম হতে হবে, কেননা জীবন্ত প্রাণীকে ধরে খাওয়াটা নশংসতা।
–রক্ষণশীলদের একটা যুক্তি আছে। তোমার ফঁদটা তোমার দাবী অনুযায়ী কর্মক্ষম হলে, এটা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
-নিয়মিত রীলিফ শুমারীর সময়ই তা বেরিয়ে আসবে। আমরা তখন বন্ধ করব। আর আমার ফাঁদ তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরের মাছ আকৃষ্ট করবে। তাছাড়া তিন দ্বীপের সবাই যদি শুধু মাছ খায়, তবুও তা সমুদ্রের ভান্ডারে ছাপও ফেলবে না।
-আমি আশা করি তুমিই ঠিক অন্ততঃ ঐ মাছ সদৃশগুলো ব্যাপারে। ওগুলো। খুবই বিষাক্ত। আর তুমি কি তেরানের মজুদ সম্বন্ধে নিশ্চিত?
ব্র্যান্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকাল। মেয়র তাকে ক্রমেই অবাক করছে। তার এর আগে কখনো মনে হয়নি যে, চোখাচোখি করা ছাড়াও মেয়রের এমন কোন গুণ আছে, যা কিনা তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহুদিন থাকতে দিয়েছে।
-আমার মনে হয় না, টুনা মাছ টিকে থাকতে পারবে। সমুদ্রকে তাদের উপযুক্ত পরিমাণে লবনাক্ত হতে আরও কয়েক বিলিয়ন বছর লাগবে। তবে ট্রাউট আর স্যামন টিকে যাবে।
–তারা আসলেই সুস্বাদু। এমনকি কৃত্রিমের সমর্থকদের নৈতিকতা ভাঙ্গার মতো। আমি অবশ্য তোমার আকর্ষণীয় তত্ত্বটা গ্রহন করছি না। ওসব লোক বলে অনেক কিছু তবে করে কম।
-তারা কয়েক বছর আগেই একটা পরীক্ষামূলক খোয়াড় থেকে পুরো একটা গৃহপালিত পশুর পাল ছেড়ে দিয়েছিল।
-তারা চেষ্টা করেছিল। গরুগুলো সোজা খোয়াড়ে ফিরে গিয়েছিল। আর সবাই এতো বেশী মজা পেয়েছিল যে তারা লজ্জায় আর কিছু করেনি। আমি মনে করি না, তারা এতো বড় কিছু করবে।