চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা গেল মহাবিশ্ব কণাযুক্ত বিচ্ছিন্ন। খালি চোখে যেমন জলপ্রপাত বা ইটের কণা দুরকম লাগলেও আসলে একই রকম। পানির “ইট” গুলো ছোট দেখে এমনিতে বোঝা যায় না। কিন্তু পদার্থবিদদের যন্ত্রপাতির সাহায্যে খুব সহজেই তা বোঝা যায়।
এরপর বিশ্লেষণটা আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। কণা সমৃদ্ধ এই মহাবিশ্ব কিভাবে এতো অকল্পনীয় রকমের শক্ত যা কিনা এর সূক্ষ্ম অতি আণুবিক্ষণীক জগতেও।
এক সেন্টিমিটারের এক মিলিয়নের এক ভাগকে কেউ সত্যিকার অর্থে কল্পনা করতে পারে না। যদিও মিলিয়নের ব্যাপারটা মানুষ বাজেট বা আদমশুমারীর জন্য আন্দাজ করতে পারে। তাই এক সেন্টিমিটারে প্রায় এক মিলিয়ন ভাইরাসকে রাখা যায় একথাটা কিছুটা হলেও বোঝা যায়।
কিন্তু এক সেন্টিমিটারের মিলিয়ন ভাগের মিলিয়ন ভাগ। এটা একটা ইলেকট্রনের আকারের সমান এবং মানুষের দৃষ্টি সীমার বহু নীচে। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কিছুটা হয়তো বোঝা যায়, তবে মন দিয়ে এতোটুকুও নয়।
আর মহাবিশ্বে কাঠামোর ঘটনাগুলোর মাত্রা এর চাইতেও অবিশ্বাস্য রকমের ছোট। এততাই ছোট যে তার তুলনায় পিঁপড়া বা হাতির মাপ একই রকম হবে। যদি কেউ এটাকে ফোমের মতো বুদ্বুদ ভাবে (যদিও এটা পুরোটাই বিভ্রান্তিকর তবুও সত্যের জন্য প্রথম প্রথম এমনটাই ভাবা যাক) তাহলে সেই বুদ্বুদগুলো….
এক সেন্টিমিটারের… মিলিয়নের মিলিয়নের মিলিয়নের সহস্র ভাগের এক ভাগ।
এখন চিন্তা করা যাক যে, সেগুলো ক্রমাগত বড় হচ্ছে আর আনবিক বোমার মতো শক্তি বিচ্ছুরণ করছে এবং সেই শক্তিই আবার পুনঃ শোষণ করছে, আবার বের করে দিচ্ছে এবং এভাবে প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকছে।
খুব মোটা দাগে ধরলে এটাই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের পদার্থবিদরা মহাবিশ্বের মৌলিক কাঠামো বলে ধরে নিয়েছিলেন। তবে এই আভ্যন্তরীন শক্তিকে বের করেই সঙ্গে সঙ্গে বেধে ফেলাটা এক কথায় বলা যায় কিস্তুত।
তাই এক প্রজন্মের আগেই আণবিক কণার মধ্য দিয়ে এই নতুন পাওয়া শক্তিকে ব্যবহারের চিন্তা করা হল। “কোয়ান্টাম তারতম্য” যার ভেতর মহাবিশ্বের শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে কাজে লাগানো অবশ্যই উঁচুমাত্রায় দুঃসাধ্য কাজ। অবশ্য সাফল্যের পুরস্কারটাও বিরাট।
অন্যসব কিছু বাদ দিলেও, এটা মানবজাতিকে মহাবিশ্বে স্বাধীনতা দেবে। একটা মহাকাশযান-তাত্ত্বিকভাবে অন্তহীনভাবে গতিবেগ বাড়াতে পারবে, যেহেতু নতুন কোন জ্বালানীর দরকার হবে না। বাস্তব সমস্যাটা অবশ্য যেটা এখানে হবে, অদ্ভুত হলেও প্রথম আকাশযানের মতোই। পারিপার্শ্বিক বাধা-মহাশূন্যে যে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো আছে তাই আলোর গতির চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যাবার আগে সমস্যা করবে।
২৫০০ সালের পর যে কোন সময়ই কোয়ান্টাম ড্রাইভ সম্ভব ছিল। আর তা হলে হয়তো মানব জাতির ইতিহাসও অন্যরকম হতো। যেভাবে আগেও বহুবার এলোমেলো পদক্ষেপে বিজ্ঞান এগিয়েছে, দূর্ভাগ্যজনকভাবে এবারও ত্রুটিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আর অসংখ্য তত্ত্ব আসল সত্যটিকে প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে দিল।
শেষের দিকের শতাব্দীগুলোতে অনেক প্রতিভার জন্ম হলেও অধিকাংশই ছিল ক্ষয়িষ্ণু আর মৌলিক জ্ঞান ছিল খুবই কম। তাছাড়া বিশাল ব্যর্থতার ইতিহাসের কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল, মহাবিশ্বের শক্তি ধরার চেষ্টা অযৌক্তিক বিরক্তিকর-যা কিনা তত্ত্বীয় ভাবেই সম্ভব নয়, বাস্তবে তো দূরের কথা। যদিও তত্ত্বীয়ভাবে এটা অসম্ভব প্রমানিত হয়নি, এবং সন্দেহাতীতভাবে তা না হলে আশা কিছুটা থেকেই যায়।
পৃথিবী ধ্বংসের মাত্র দেড়শ বছর আগে ল্যাগরেনজ-১ মধ্যাকর্ষণবিহীন গবেষণা উপগ্রহের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন যে তারা এতোদিনে খুঁজে পেয়েছেন যে, কেন মহাবিশ্বের শক্তি বাস্তব হলেও বাস্তবে ব্যবহার করা যাবে না। বিজ্ঞানের অস্পষ্ট একটা কোনাকে এভাবে গিট্ট দেয়ার ঘোষণার প্রতি অবশ্য কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
এক বছর পর ল্যাগরেনজ-১ থেকে বিব্রত একটা গলা খাকরী শোনা গেল। ঐ প্রমাণে ছোট্ট একটা ভুল পাওয়া গেছে। এরকম অবশ্য অতীতেও কয়েকবার হয়েছে, তবে কখনোই এতো সঠিক মুহূর্তে নয়। একটা বিয়োগচিহ্ন যোগচিহ্ন হয়ে গেল।
এবং সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বই বদলে গেল। নক্ষত্রের দিকের রাস্তা খুলে গেল মধ্যরাতের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে।