কারণ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হবার কোন দরকার ছিল না। পৃথিবীর সম্পদ এবং অর্থ খুব পরিষ্কার বিবেক নিয়েই উড়িয়ে দেয়া যায়। বস্তু হিসেবে হিসাব করলে সমস্ত মানুষই কোটিপতি, যা তাদের পূর্বপুরুষরা চিন্তাও করতে পারেনি। বিকৃত একটা গর্বের সঙ্গে তারা তাদের বলত- শেষের দিনের প্রভু। বিস্মৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে অধিকাংশরা পছন্দ করলেও সব সময়ের মতো কিছু মানুষ ছিল যারা তাদের নিজের জীবনেরও পরের কোন লক্ষ্যের প্রতি কাজ করতে আগ্রহী। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলতে লাগল। বিশেষত মুক্ত হয়ে যাওয়া সব সম্পদ দিয়ে। যদি কোন পদার্থবিদ কয়েকশ টন সোনা চাইত পরীক্ষার জন্য, সেটা জোগাড়েই যা সমস্যা হবে কেনায় নয়।
তিনটা ভাব প্রাধান্য পেল। প্রথমটা হলো সূর্যকে সার্বক্ষণীক ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নয় বরং ধ্বংসের সময়টার ভবিষ্যৎবাণী একদম নিখুঁত করে করার জন্য, বছর দিন ঘন্টাসহ…
দ্বিতীয়টা হলো ভিনগ্রহের বুদ্ধিমানদের খোঁজা। শতাব্দীর ব্যর্থতার পর যা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এখন তার নিশ্চিত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা গেল। তবে এমনকি শেষেও আগের চাইতে বড় কোন সাফল্য ধরা পড়ল না। মানুষের এতো প্রশ্ন সত্ত্বেও মহাবিশ্ব তার নোংরা উত্তরই দিয়ে গেল।
আর তৃতীয়টা হল কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোকে কোনী করা, যাতে মানব জাতি সূর্যের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে।
শেষ শতাব্দীর শেষ দিকে পঞ্চাশটারও বেশী লক্ষ্যে আগের চাইতে দ্রুত ও আধুনিক মহাকাশযান পাঠান হল। অধিকাংশই ধারণার মতো ব্যর্থ হল, কিন্তু অন্ততঃ দশটা আংশিক সাফল্যের বার্তা পাঠাল। শেষেরগুলোর প্রতি আশা অনেক বেশী থাকলেও সেগুলো পৃথিবী ধ্বংসের আগে পৌঁছুতেই পারবে না। একদম শেষেরটা আলোর গতির বিশ শতাংশে পৌঁছুতে পারে এবং নশ পঞ্চাশ বছরেই সব কিছু ঠিকঠাক চললে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে।
লোরেন এখনও চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝখানের নির্মানস্থান থেকেই “এক্সক্যালিবারের” উৎক্ষেপনটা স্মরণ করতে পারে। যদিও তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ কিন্তু সে জানত এটাই এধরনের শেষ মহাকাশযান। কিন্তু শতাব্দীব্যাপী লম্বা এই পরিকল্পনা, প্রযুক্তির পরিপূর্ণতায় এসে কেন বাতিল হলো তা বোঝার বয়স অবশ্য তার ছিল না। এমনকি পৃথিবীর শেষ যুগগুলোর বিস্ময়কর আবিষ্কার মানবজাতিকে নতুন আশা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবন কিভাবে বদলে গেল সে সমন্ধেও তার বোঝার বয়স হয়নি। অসংখ্য তত্ত্বীয় গবেষণা হলেও কেউই মানুষ চালিত মহাকাশ যাত্রার বাস্তব রূপ দেখাতে পারেনি-এমনকি পাশের নক্ষত্রটি পর্যন্ত। শত বছরের যাত্রায় সময়টা ব্যাপার না। সেটা হিমনিদ্রার মাধ্যমেই মেটানো সম্ভব। লুই পাস্তুর উপগ্রহ হাসপাতালে একটা বাঁদর এক হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে এবং এখনও সেটার মস্তিষ্কের কাজ স্বাভাবিক। মানুষ যে পারবেনা তাও ঠিক না। কারণ এক সন্দেহভাজন ক্যান্সারের রোগী দু’শ বছরের বেশী ধরে ঘুমিয়ে আছে। শারীরবৃত্তীয় সমস্যার সমাধান আছে। কিন্তু প্রযুক্তির সমস্যাটা দুর্লজ্জ। হাজার খানেক নিদ্রিত মানুষ নিতে পারে এমন একটা মহাকাশযান প্রাচীন সামুদ্রিক জাহাজের মতোই হবে। এধরনের একটা জাহাজ মঙ্গলের পর গ্রহাণুর অফুরন্ত সম্পদ ব্যবহার করে বানানো সম্ভব। কিন্তু বিশাল সময় ধরে কাজ করবে এধরনের। ইঞ্জিন তৈরী হচ্ছে অসম্ভব।
আলোর গতির এক দশমাংশের গতি হলেও সবচে কাছের সম্ভাবনাময় লক্ষ্যে যেতে পাঁচশ বছর লাগবে। ছোট রোবট যানগুলো এই গতি তুলতে পারে। কাছের নক্ষত্রগুলোর দিকে ধেয়ে যায় আর প্রথম বারের উন্মাতাল ঘন্টার বর্ণনা পাঠায়। কিন্তু তারা কোনো ভাবেই তাদের অবতরণের গতিকে কমিয়ে আনতে পারে না। দুর্ঘটনা না হলে তারা তাদের গতিবেগ বাড়িয়েই যায়। রকেট নিয়ে এটা একটা মূল সমস্যা এবং গভীর মহাশূন্য ভ্রমনে এর বিকল্পও কেউ দেখাতে পারেনি। গতি ওঠানোর মতোই গতি নামানোও একই সমস্যা। গতি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী নেয়া শুধু যাত্রাকে দ্বিগুন ঝামেলাই দেয় না। এটা অসম্ভব করে তোলে।
একটা মহাকাশযানকে আলোর গতির এক দশমাংশে তোলা যায়। কয়েক মিলিয়ন টন জ্বালানী দিয়ে কাজটা কঠিন হলেও সম্ভব। কিন্তু যাত্রার পর সেই গতি কমাতে আবার মিলিয়ন না তারও বেশী মিলিয়ন মিলিয়ন টন জ্বালানী লাগবে। এটা সম্ভব নয় বলেই কেউ এটা নিয়ে চিন্তা করেনি।
আর এরপরই হল ইতিহাসের সবচে বড় রসিকতা। মানবজাতিকে মহাবিশ্বের চাবি দিয়ে দেয়া হলো এবং মাত্র এক শতাব্দী পেল তারা তা ব্যবহারের জন্য।
৮. পুরোনো সেই দিনের কথা
মোজেস ক্যালডর ভাবল, কি সৌভাগ্যবান আমি। আমি কোনদিন শিল্প কলা এবং প্রযুক্তির প্রলোভনে আকর্ষিত হইনি, যা কিনা হাজার বছর ধরে মানবজাতিকে দেয়া হয়েছে। ইভলিনের ইলেকট্রনিক ভূতকে কয়েক গিগাবাইটের প্রোগ্রামে নিয়ে আসার কোন ইচ্ছে কি আমার ছিল?
সে আমার সামনে আসতে পারত। যে কোন পটভূমিতে আমরা ভালোবাসতে পারতাম এবং এমনভাবে কথা বলতাম যে কোন আগন্তুক বুঝতেই পারত না যে, সেখানে কেউ বা কিছুই নেই।
কিন্তু পাঁচ বা দশ মিনিট পর আমি নিজেকেই জোর করে প্রতারিত করব। আর সেটা আমি কখনোই করব না। যদিও আমি কেন এর বিরুদ্ধে সে সম্বন্ধে আমি নিজেই নিশ্চিত না। আমি সব সময় মৃতের সঙ্গে মিথ্যে সান্তনার বাণী শোনাকে প্রত্যাখান করেছি। এমনকি আমি তার কণ্ঠের সাধারণ রেকর্ড পর্যন্ত রাখিনি। এর চাইতে এইই ভালো। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে তাকে দেখা। আমাদের শেষ বাড়ীর ছোট্ট বাগানে। এটুকু অন্ততঃ জানা, যে এটা কোন প্রতিরূপ বানিয়ের তৈরী নয়, এটা সত্যিই হয়েছিল দু’শ বছর আগের পৃথিবীতে। এখানে এখন শুধু আমারই কণ্ঠস্বর। আমার নিজেরই স্মৃতির সঙ্গে কথা বলা-যা আমার মানবীয় মস্তিষ্কে বেঁচে আছে।