অনেকে বলতে পারেন, আবিস্কৃত পদ্ধতিগুলো যদি অসত্য হয় তাহলেও সেগুলো তো কারও ক্ষতি করে না বরঞ্চ উপভোগ্য, সেজন্য ওসবের বিরোধিতা করা উচিত নয়। প্রকৃত ক্ষতিকারক না হয়ে আনন্দ দিতে সক্ষম হলে এর ঋণ শোধ করতে হয়। আংশিকভাবে নৈসর্গিক অবস্থা থেকে এবং আংশিকভাবে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের ফলেই জীবনে দুঃখ বেদনার সৃষ্টি হয়। সাবেক যুগে মানুষকে খাবারের প্রতিযোগিতায় যুদ্ধে নামতে হতো এবং জয়ী হতে না পারলে তারা খাবার পেত না। বর্তমানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে প্রকৃতি যা দিতে শুরু করেছে, একজন দু’জন না করে সামগ্রিকভাবে সকলে যদি একসঙ্গে বিজ্ঞানের সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, তাহলে মানবসমাজকে অধিকতর সুখী এবং সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তোলা যাবে। অন্য মানুষের সঙ্গে সংগ্রামে প্রকৃতিকে সহায় অথবা, শত্রু হিসেবে ব্যবহার করার মধ্যে পৃথিবীতে মানুষের আসল অধিকার সূচিত হয় না। তা হলে, শক্তির বৈজ্ঞানিক প্রতীতি থেকে তার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়, অথচ বৈজ্ঞানিক সংগ্রামের মাধ্যমেই পৃথিবীতে স্থায়ী কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ব্যবহারিক যুক্তিসমূহ বাদ দিলে সুখের সন্ধান করার যে প্রবৃত্তি তা অসত্য বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মহৎ গৌরবান্বিত দু’টার কোনটাই নয়। পৃথিবীতে মানুষের সত্যিকারের স্থান কোথায় তা চিন্তা করে যারা সংস্কারের দেয়ালে আত্মরক্ষা করে এটা তাদের কাজে দুর্লভ জীবনের বলিষ্ঠ আনন্দের আস্বাদ। পক্ষান্তরে যারা চিন্তা দুর্ণাব্য সমুদ্রে পাড়ি জমাতে সাহস করে, তারাই আপন শক্তিহীনতার মুখোমুখি নির্ভয়ে দাঁড়াতে পারে। সর্বোপরি এতে ভয়ের পীড়ন থেকে মুক্তি মেলে-যে ভয় দিনের আলোকে ঢেকে রাখে এবং মানুষকে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর করে। যে মানুষ পৃথিবীতে তার স্থান কোথায় খুঁজে পায় না সে কখনও ভয় থেকে মুক্তি পায় না, সে কখনও সম্ভাব্য মহত্ব অর্জন করতে পারে না।
০৩. বিজ্ঞান কি কুসংস্কারাচ্ছন্ন?
আধুনিক জীবন দু’ভাবে বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। একদিকে আমাদের সকলকে দৈনন্দিন রুটি-রোজগার এবং আরাম-আয়েশের জন্য বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে মনের কতেক স্বভাব যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, বিগত তিনশ বছর ধরে কয়েকজন প্রতিভাবানের কাছ থেকে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানের এ দু’রকমের প্রভাব যে পরস্পর অনিষ্ট তা সুদীর্ঘকাল ধরে বিচার বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে, কিন্তু একটা অন্যটাকে ছাড়া কয়েকশ বছর পর্যন্ত চলে যেতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক ছাড়া মনের বৈজ্ঞানিক স্বভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। কারণ তার আগে বিরাট বিরাট আবিষ্কারের ফলে শিল্পোৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লবের সঞ্চার হয় নি। অন্যদিকে বিজ্ঞান যে ধরণের জীবন পদ্ধতির সৃষ্টি করেছে তা তারাই গ্রহণ করল শুধু বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাদের সামান্য বাস্তব জ্ঞান আছে এবং এ সমস্ত লোকেরা যেখানেই আবিষ্কৃত হোক না কেন যন্ত্র তৈরি, ব্যবহার এমনকি অল্পস্বল্প উৎকর্ষ সাধনও করতে পারে। মানবজাতির সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি যদি লোপও পায় তাহলেও যে কারিগরি এবং দৈনন্দিন জীবনের সৃষ্টি করেছে তা সমগ্র সম্ভাবনাসহ কয়েকপুরুষ ধরে অক্ষয়ভাবে বিরাজ করবে। কিন্তু চিরদিনের মতো স্থায়ী হতে পারবে না, কেননা কোন আকষ্মিক বিপত্তির ফলে ধ্বংস হয়ে গেলে এর পূণর্নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সুতরাং ভালোর জন্য হোক, মন্দের জন্য হোক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতির একান্তই প্রয়োজন। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গীর মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীও দু’ভাবে বিভক্ত। স্রষ্টা এবং সমালোচক, দু’জনেই আলাদা মানুষ এবং তাদের প্রত্যেকেরই মনের আলাদা স্বভাব। অন্যান্য স্রষ্টার মতো বৈজ্ঞানিক স্রষ্টারাও আবেগে উদ্দীপিত হন, যার ফলে তারা অপ্রকাশিত সত্যের বুদ্ধিগ্রাহ্য বর্ণনা দিতে পারেন। এ না হলে কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারবেন না। সমালোচকের এ ধরনের বিশ্বাস বা প্রত্যয় না থাকলে চলে। তিনি প্রয়োজন মতো আনুপাতিকভাবে জ্ঞাত হয়ে সংরক্ষণ করেন এবং নিজের তুলনায় স্রষ্টাকে একজন কদর্য বর্বরব্যক্তি হিসেবেও ভাবতে পারেন। যখন সভ্যতা অত্যধিক পরিব্যপ্ত এবং ঐতিহ্যাশ্রয়ী হয়ে পড়েছে তখন সমালোচকদের মনে স্রষ্টাদের মন জয় করবার প্রবৃত্তিও দেখা গেছে। এর ফলে সভ্যতার প্রশ্ন বাইজানটাইনের মতো পুরনো এবং বহিদর্শনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানেও অনুরূপ কিছু বোধকরি ঘটতে শুরু করেছে। যে সরল বিশ্বাসের রজ্জু ধরে পুরোধা ব্যক্তিরা অগ্রসর হচ্ছিলেন তার মর্মমূল এখন শুকিয়ে গেছে। বাইরের জাতিগুলো যেমন রাশিয়ান জাপানি এবং তরুন চীনারা এখনও বিজ্ঞানকে সপ্তদশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্যেমণ্ডিত হিসাবে দেখতে চান, তেমনি চান প্রতীচ্যের অনেকগুলো জাতি। কিন্তু ধর্মযাজকেরা এখন তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিবেদিত ধর্ম-কর্মে আস্থা স্থাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ধার্মিক তরুণ লুথার একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন পোপকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তিনি তার রোগমুক্তি কামনা করে রোমের মন্দিরে জুপিটার দেবতার কাছে ষাঁড় বলি দিয়েছিলেন। বর্তমানে সভ্যতা সংস্কৃতির পীঠস্থান থেকে যারা দূরবর্তী তারাও বিজ্ঞানের প্রতি তেমনি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন। জার্মান প্রোটেস্টানিজমের মতো বলশেভিকদের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদও হলো পুরনো শ্ৰেয়োবোধকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা, যা বন্ধু এবং শত্রু সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে নতুন মতবাদ হিসাবে। নিউটনের মৌলিক আনুপ্রেরণা পশ্চিমের বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংশয়বাদের জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞানকে ক্রিয়াপদ্ধতি হিসাবে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উৎসাহদাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেনেসি রাজ্যের মতো রাষ্ট্র যেখানে প্রাকবৈজ্ঞানিক স্তর অতিক্রম করতে পারে নি, সেখানে ছাড়া রাজনৈতিকভাবে অন্যান্য রাষ্ট্র রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। পূর্বের অবস্থা রক্ষা করাই আজকের বিজ্ঞানের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলতঃ তারা বিজ্ঞানের যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি কিছু দাবি করতে ইচ্ছুক নন। ধর্মের মতো রক্ষণশীল শক্তির চাইতে বিজ্ঞানের দাবি যে বেশি, তা তারা স্বীকার করেন না।